শিল্পই হাতিয়ার বুদ্ধ-সূর্যের, উঠল সিঙ্গুরও

ফেরার যুদ্ধে জোড়া কৌশল সিপিএমের

শাসক দলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ, গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ, দুর্নীতি— সাম্প্রতিক কালে এ সব নিয়েই বেশি সরব ছিল প্রধান বিরোধী দল। গত কয়েক বছরের মধ্যে অন্যতম বড় ব্রিগেড সমাবেশ থেকে রবিবার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র দু’জনেই স্পষ্ট করে দিলেন, শিল্পায়ন আর বেকারদের কর্মসংস্থানের মন্ত্রকে সামনে রেখেই তাঁরা আগামী বিধানসভার ভোটে লড়বেন।

Advertisement

প্রসূন আচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৩:৫১
Share:

জনসমুদ্র ব্রিগেডে। রবিবার সুদীপ্ত ভৌমিকের তোলা ছবি।

ঘুরে দাঁড়ানো বা প্রতিরোধের কথা অনেক হয়েছে! এ বার শিল্পায়ন আর কর্মসংস্থানের স্লোগানকে সামনে রেখেই তৃণমূলকে উৎখাতের ডাক দিয়ে রাজ্যে সরাসরি নতুন সরকার গ়ড়ার ডাক দিল সিপিএম।

Advertisement

শাসক দলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ, গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ, দুর্নীতি— সাম্প্রতিক কালে এ সব নিয়েই বেশি সরব ছিল প্রধান বিরোধী দল। গত কয়েক বছরের মধ্যে অন্যতম বড় ব্রিগেড সমাবেশ থেকে রবিবার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র দু’জনেই স্পষ্ট করে দিলেন, শিল্পায়ন আর বেকারদের কর্মসংস্থানের মন্ত্রকে সামনে রেখেই তাঁরা আগামী বিধানসভার ভোটে লড়বেন। বস্তুত, বেশ কিছু দিন পরে আক্রমণাত্মক ভূমিকায় দেখা গেল সিপিএমকে। এবং এ বারের ব্রিগেড থেকে তাঁরা যে অন্তত ‘ইতিবাচক বার্তা’ নিয়ে ফিরতেছেন, সভা শেষে বাম কর্মী-সমর্থকদের প্রতিক্রিয়া থেকেই তা পরিষ্কার।

প্লেনাম উপলক্ষে সমাবেশ হলেও এ দিনের ব্রিগেডকে আসন্ন বিধানসভা ভোটের দামামা বাজানোর কাজেই ব্যবহার করেছে সিপিএম। অসুস্থ শরীরে অল্প ক্ষণের জন্য বক্তৃতা করেছেন বুদ্ধবাবু। বলেছেন, ‘‘তৃণমূল এ রাজ্যকে সর্বনাশের কিনারায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়েছে! এই রাজ্য এখন দেউলিয়া। যুবকদের ভবিষ্যৎ নেই।’’ তাঁর কথায়, ‘‘কল-কারখানা হচ্ছে না। আর মানুষের আত্মহত্যার উপরে সরকার উৎসব করছে!’’ তৃণমূল নেত্রীর ঢঙে তাঁর স্লোগানে সুর মেলাতে সভাকে আবেদন জানিয়ে বুদ্ধবাবু নিজেই স্লোগান তোলেন, ‘তৃণমূল হঠাও, বাংলা বাঁচাও’!

Advertisement

তৃণমূলের সাড়ে চার বছরে শিল্পায়ন নিয়ে বহু ‘মউ’ স্বাক্ষরিত হলেও বাস্তবে শিল্প যে তেমন একটা হয়নি, শাসক দলের অন্দরে নেতা-মন্ত্রীরাও তা স্বীকার করেন। এমনকী শাসক দলের জেলাস্তরের নেতারাও দলীয় কর্মিসভায় গিয়ে শিল্পে ব্যর্থতার কথা মেনে নিয়েছেন। সম্প্রতি বাঁকুড়া জেলা পরিষদের তৃণমূলের সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তী দুর্গাপুরে দলীয় সভায় গিয়ে স্বীকার করেছেন যে, পরিবর্তনের জমানায় শিল্পে সে ভাবে কোনও অগ্রগতি হয়নি! মুখ্যমন্ত্রী মুম্বইয়ে শিল্প সম্মেলন করে বা লন্ডন-সিঙ্গাপুরে গিয়েও তেমন বড় বিনিয়োগ টানতে পারেননি। মুখ ফিরিয়েছে ইনফোসিস বা জিন্দলদের মতো সংস্থাও। জমি নিয়ে তৃণমূল সরকারের অনড় অবস্থানের জন্য একলপ্তে জমি পাওয়াও প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিল্পের এই বেহাল দশারই সদ্ব্যবহার করতে চায় সিপিএম। তা ছাড়া, দুর্নীতির অভিযোগ যে সব সময় ভোটবাক্সে প্রভাব ফেলে না, তার প্রমাণও গত লোকসভা ভোটের ফল থেকে অনেকটাই স্পষ্ট বাম নেতাদের কাছে। সে বার সারদা নিয়ে বিরোধীদের তুমুল প্রচারের পরেও রাজ্যের বেশির ভাগ আসনই গিয়েছিল শাসক দলের পক্ষেই! তা ছাড়া ২০০৬-এ শিল্পায়নের ডাক দিয়েই শেষ বার বিপুল জয় পেয়েছিল বুদ্ধবাবুর নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট। এ বারেও শিল্পায়নকেই হাতিয়ার করছেন তাঁরা।

বুদ্ধবাবুর জমানায় শিল্পায়নের গতি বাড়াতে গিয়ে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ঘটনার পরে বেলাইন হয়েছিল বাম সরকার। কিন্তু পরিবর্তনের পরে শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের হাত যে শূন্যই রয়ে গিয়েছে, তা বুঝে শিল্প ও কর্মসংস্থানের মন্ত্রকেই ফের সামনে রাখতে চাইছেন বুদ্ধবাবুরা। তারই ইঙ্গিত দিয়ে সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম বলেছেন, ‘‘ক্লাবকে টাকা, এখানে টাকা, ওখানে টাকা! দান-খয়রাতি আমরা চাই না। মানুষ চায় কাজ! তেলে ভাজাকে শিল্প বলে কত দিন চালাবেন?’’ সমাবেশে এ দিন তরুণ প্রজন্মের উপস্থিতি ছিল ভালই। এমন মন্তব্য শুনে তাঁরা বিপুল সমর্থনও জানিয়েছেন!

ক্ষমতায় ফিরলে তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে গরিবের টাকা ফেরত, কৃষকদের আত্মহত্যা, চা-বাগানে অনাহারে মৃত্যু, নারী নির্যাতন— সিপিএম নেতারা সমস্ত বিষয় ছুঁয়ে গেলেও শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে তৃণমূলের ব্যর্থতাকেই যে তাঁরা সামনে আনতে চান, সূর্যবাবুর কথায় তা আরও স্পষ্ট। তিনি বলেছেন, ‘‘উনি (মমতা) সিঙ্গুরের জমি ফেরত দিতে পারেননি। কারখানাও হয়নি। সিঙ্গুরে আবার কারখানা আমরাই করতে পারব।’’ বামেরা ফিরলে পুরুলিয়ার রঘুনাথপুর, পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনি বা পূর্ব মেদিনীপুরের নয়াচরেও শিল্প হবে বলে মন্তব্য সূর্যবাবুর।

শিল্প নিয়ে সিপিএমের প্রচারকে পাল্টা কটাক্ষ করে তৃণমূলের মহাসচিব তথা রাজ্যের প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘যারা ৩৪ বছরে কিছু করতেই পারল না, তারা এখন বলছে কারখানা করবে!’’ পরক্ষণেই তাঁর মুখে সিঙ্গুর প্রসঙ্গ, ‘‘আমরা তো বলেই আসছি, অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি ফেরত দিয়ে সিঙ্গুরে কারখানা হবে।’’ তাঁর আরও কটাক্ষ, ‘‘এখন যেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নয়াচরে গিয়েছেন, অমনি তাদেরও মনে হল ওখানে কিছু করার কথা বলতে হবে!’’ সিঙ্গুরে কারখানা চেয়েও বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ‘‘৩৪ বছরে রাজ্যে শিল্পায়নের গতি কেমন ছিল, মানুষ দেখেছেন! বাম জমানাতেই কর্মসংস্থানের খোঁজে মানুষকে অন্য রাজ্যে যেতে হতো।’’

সিপিএম নেতারা তৃণমূল-বিজেপি’কে এক বন্ধনীতে রেখেই আক্রমণ শানিয়েছেন এ দিন। তাঁরা বিলক্ষণ জানেন, বামেদের একার পক্ষে তৃণমূলকে হারানো কঠিন! তাই বামফ্রন্টের বাইরের মানুষকেও যে তাঁরা সঙ্গে চান, এ দিন দলের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি থেকে সূর্যবাবু, সেলিম থেকে মানিক সরকার— সকলেই তা বুঝিয়েছেন। তাঁর সাম্প্রতিক সুর বজায় রেখেই ইয়েচুরি তৃণমূল ও বিজেপি-কে হঠানোর কথা বললেও কংগ্রেসের বিরুদ্ধে একটি শব্দও খরচ করেননি। আর সেলিম বলেন, ‘‘যাঁরা বাংলার ভাল চান, তাঁদের সবাইকে একজোট হয়ে লড়তে হবে। এক ছাতার তলায় আসতে হবে।’’ সমাবেশে সব চেয়ে বেশি হাততালি পেয়েছেন সেলিমই। বলিউডের সাম্প্রতিক ছবি ‘দিলওয়ালে’র গানের কলি থেকে তিনি যখন বলছেন, ‘‘দিদি এখন বলছেন, রং দে তু মোহে গেরুয়া’’, উচ্ছ্বাসে ভেসে গিয়েছে মাঠ!

এই সংক্রান্ত আরও খবর...

কৌশলে জোটের পথ খুলল প্লেনাম-প্রস্তাবে

ভয় ভেঙেই লড়াইয়ের বার্তা নিয়ে ভরল ব্রিগেড

সূর্যের হুঁশিয়ারি, তারুণ্যে হোঁচট দলেই

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন