ধানের বদলে মুড়ি। বীরভূমের শালজোড়ে। —নিজস্ব চিত্র।
এক কিলো ধান ১০ টাকা।
সঞ্চয় থেকে চার কিলো চারশো গ্রাম ধান জমা করলেন শাহিদা বিবি। বিনিময়ে নিয়ে গেলেন ১০ টাকার মুড়ি, ১২ টাকার চিনি ও ১০ টাকার মুসুর ডাল। হিসেব মতো শাহিদার খাতায় জমা রইল আরও ১২টি টাকা।
নগদ টাকার অভাবে গ্রামীণ অর্থনীতি যখন টলমল, ঠিক তখনই বীরভূমের প্রত্যন্ত গ্রাম শালজোড়ে প্রাচীন বিনিময় প্রথা চালু করে শাহিদাদের মতো ভুক্তভোগীদের সংসারের হাল ধরেছেন দুই বাসিন্দা। এক জন ষাট ছুঁইছুঁই প্রৌঢ়। দ্বিতীয় জন ষাটোর্ধ্ব বিধবা। সম্বল বলতে ছোট্ট দু’টি মুদিখানা। সেই মুদিখানার দ্বার খুলে দিয়েই এই ‘অচল’ সময়ে ঝাড়খণ্ড সীমানা ঘেঁষা বাংলার এক প্রত্যন্ত গ্রামকে সচল রেখেছেন আব্দুল গনি আর তাহসেনা বিবি।
ওই দু’জন সাহায্য না করলে বাড়িতে আর হাঁড়িই চড়ত না বলে জানাচ্ছেন খয়রাশোল ব্লকের লোকপুর পঞ্চায়েতের শালজোড়ের বাসিন্দারা। কখনও সম্পূর্ণ ধারে কখনও বা প্রাচীন আমলের বিনিময় প্রথাকে অবলম্বন করে গ্রামীণ এই অর্থনৈতিক সঙ্কটের মোকাবিলা করছেন আব্দুল-তাহসেনা।
কী ভাবে?
আব্দুলরা বলছেন, ‘‘ছোট্ট দোকান। গ্রামের মানুষ জিনিস অল্পস্বল্প নিতেন। কেউ আবার বাইরে থেকে নগদে কিনে আনতেন। কিন্তু টাকা অচল হওয়ায় বিপদে পড়েছেন। যাঁরা নিয়মিত জিনিস নিতেন, তাঁদের যতটা সম্ভব ধারে দিচ্ছি। আর বাকিদের কথা ভেবে সমান টাকার ধান নিয়ে জিনিস দিচ্ছি।’’ কিলো প্রতি ১০ টাকা দরে তাহেসানার কাছেই যেমন ৩ কিলো ১০০ গ্রাম ধান দিয়ে চা-চিনি-বিস্কুট মিলিয়ে ২৩ টাকার জিনিস কিনলেন প্রমীলা বাউরি। প্রমীলা পরে ৮ টাকার জিনিস নিতে পারবেন কোনও কিছু না দিয়েই। অবার উল্টোটাও আছে। কেউ কম ধান দিয়ে একটু বেশি টাকার জিনিস কিনলে খাতায় বাকি থেকে যাচ্ছে বিক্রেতার কাছে। এই বাজারে শুধু ধানই নয়, পরিস্থিতি বুঝে হাঁস-মুরগির ডিম বা দুধের বদলেও তাঁরা জিনিসপত্র দিচ্ছেন।
শুধু শালজোড়ই নয়, নোট বাতিলের ফেরে ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, অসম-সহ বেশ কিছু রাজ্যের প্রত্যন্ত গ্রামেও আমজনতা রোজের খাবার জোগাড়ে বেছে নিয়েছেন প্রাচীন বিনিময় প্রথা। এ রাজ্যের কিছু জেলাতেও ধান কাটার শ্রমিকদের মজুরির বদলে ধান দিচ্ছেন চাষিরা। অর্থনীতির শিক্ষক অভিরূপ সরকার কিন্তু মনে করেন, সাময়িক সুরাহা হলেও এটা আদতে পিছন দিকে ফিরে যাওয়া। ‘‘বিনিময় প্রথা বহু বহু যুগ আগে ছিল। তার কিছু কিছু অসুবিধা ছিল বলেই তো মুদ্রার প্রচলন হয়েছে। এ জিনিস এখন চলতে পারে না। এটা দেশের অর্থনীতির পক্ষে ভাল নয়।’’—বলছেন তিনি।
৮০টি কৃষিজীবী পরিবার নিয়ে গড়ে ওঠা শালজোড়ের বাসিন্দারা কিন্তু বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে দিনের খাওয়া জোটাচ্ছে বিনিময় প্রথাই। একে এই গ্রামে ঢুকতে হলে প্রথমে ঝাড়খণ্ডের দু’টি গ্রাম পার করতে হয়। তার উপরে, এটিএম তো দূর, গ্রাম থেকে সব থেকে কাছের ডাকঘরই ১৪ কিলোমিটার দূরে। লোকপুরের
গ্রামীণ ব্যাঙ্ক আট কিলোমিটার। খয়রাশোলের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কটিও ১৬ কিলোমিটার দূরে। গ্রামবাসী ইনজামাম হোসেন, শরৎ বাউরিরা বলেন, ‘‘সমস্ত কাজ ফেলে কষ্ট করে যদিও বা ব্যাঙ্ক-পোস্ট অফিসে লাইন দিয়ে পুরনো নোট জমা দিতে পেরেছি, টাকা ফেরত পেতে ঘাম ছুটেছে।’’ শোভন বাউরি, আতাউল শেখরা জানাচ্ছেন, এখন ধান উঠছে। তা বিক্রি করে যে টাকা পাবেন, সে রাস্তাও আপাতত বন্ধ।
এই সঙ্কট-কালে বাসিন্দাদের সহায় হয়েছেন আব্দুল ও তাহসেনা। গ্রামের লায়লা বিবি, হেনা বিবি, তরুলা বাউড়িরা বলছেন, ‘‘ওঁদের জন্যই এখন বাড়িতে হাঁড়ি চাপছে। কিন্তু নগদ টাকা না পেলে অসুখ-বিসুখ ও অন্যান্য প্রয়োজনে কী করব? আমাদের এখানে মূল আয়ের পথ ধান বিক্রি আর দিনমজুরি। সে সবই ধার বাকিতে চলছে, নয়তো থমকে গিয়েছে।’’
তাহসেনা আর আব্দুল মানছেন, ‘‘আগে এমনটা কখনও হয়নি। তাই বিনিময় পদ্ধতিই চালু করেছি। কিন্তু এ ভাবে চললে আর বেশি দিন টানতে পারব না। যাঁদের কাছ থেকে মাল আনি, নোটের আকালে তাঁরাও যে ধীরে ধীরে হাত তুলে দিচ্ছেন।’’