চিংড়ি-ইলিশ, মুরগি-মাটনে আজ মহাভোজ

লর্ডসে বা ইডেনে সেঞ্চুরি করলে লোকে কী করে? শ্যাম্পেন উড়িয়ে পার্টি করে। রাজ্য সরকার অবশ্য তা করছে না। মুখ্যমন্ত্রীর শততম প্রশাসনিক সভা নিশ্চয়ই তার যোগ্য জায়গা নয়! তা শ্যাম্পেন যদি না-ই বা থাকে, যা আছে তা-ই বা কম কী? ক’দিন বাজারে মুখ দেখানোর পরে ইলিশ ফের বিবাগী।

Advertisement

সৌমেন দত্ত

বর্ধমান শেষ আপডেট: ১৫ জুলাই ২০১৫ ০৩:৫০
Share:

সভার আগে প্রস্তুতি। বর্ধমানের পুলিশ লাইনে উদিত সিংহের তোলা ছবি।

লর্ডসে বা ইডেনে সেঞ্চুরি করলে লোকে কী করে?

Advertisement

শ্যাম্পেন উড়িয়ে পার্টি করে।

রাজ্য সরকার অবশ্য তা করছে না। মুখ্যমন্ত্রীর শততম প্রশাসনিক সভা নিশ্চয়ই তার যোগ্য জায়গা নয়!

Advertisement

তা শ্যাম্পেন যদি না-ই বা থাকে, যা আছে তা-ই বা কম কী?

ক’দিন বাজারে মুখ দেখানোর পরে ইলিশ ফের বিবাগী। কিন্তু ঘোর বর্ষায় ইলিশ ভাপা ছাড়া মান রাখা দায়। আবার চিংড়ি না রাখলেই বা লোকে বলবে কী! চাই কি, ‘বাঙাল’ও বলে বসতে পারে মোহনবাগানিরা। অতএব লাও গলদা চিংড়ি!

কিন্তু সরকারি যজ্ঞিবাড়ির খাওয়া কি অত অল্পে মেটে? এমন যদি কেউ থাকেন যিনি মোটে ইলিশের কাঁটা বাছতে পারেন না, আবার চিংড়িতেও অ্যালার্জি? ভেটকি তাই রাখতেই হল। আর মধ্যে একটু মুখ ছাড়ানোর জন্য পাবদার ঝাল।

এর পরে আবার মাংস ?

শুনেই জেলার এক কর্তা চোখ গোলগোল করে ফেলেন, ‘‘কত লোক মাছ খায় না জানেন? তা ছাড়া এত বড় আয়োজন, পাতে মাংস না হলে কেমন দেখায়?’’ তা বলে দু’রকম? ‘‘পাঁঠাই ভাল মানায়, কিন্তু আজকাল অনেকের আবার কোলেস্টেরলের বাতিক, জানেন তো?’’ মিষ্টি করে হাসেন ভদ্রলোক। বর্ধমানের সংস্কৃতি লোকমঞ্চের পিছনে রান্নার জায়গায় মুরগি কোঁকর-কোঁ করে ওঠে।

আজ, বুধবার দুপুরে ২টোয় এই লোকমঞ্চেই মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক বৈঠক। এখানেই খাওয়ার আয়োজন। তাতে সরকারি অফিসার ও প্রতিনিধি মিলিয়ে ছ’শো জন হাজির থাকবেন। বুফের ব্যবস্থা সেখানেই। বেশির ভাগ প্যাকেটও সেখান থেকেই বিলি হবে।

প্যাকেট যাঁরা পাচ্ছেন, তাঁরা অবশ্য দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির নিমন্ত্রিত। আসলে ঠিক ‘নিমন্ত্রিত’ নয়, যাঁদের ছাড়া এই আয়োজন করাই যেত না, তাঁরা। এর মধ্যে বিডিও বা তাঁর উপরের স্তরের অফিসারেরা যেমন আছেন, আছেন রোদে-বৃষ্টিতে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা রক্ষীরা। আছে ফুল সাজানোর ছেলেটিও। এঁদের ভাগ্যে মাছ-মাংস নেই, শুধুই ‘ভেজ’ আর স্ন্যাকসের নামে প্যাকেট ভরা ঝুরি ভাজা বা চানাচুর। বিভিন্ন ব্লক থেকে যাঁদের আনা হবে, তাঁরা এই হিসেবের বাইরে। তাঁদের জন্য রুটি-তরকারি বা কলা-পাঁউরুটি বা কেকের ব্যবস্থা করতে হবে বিডিওদেরই।

যিনি এই মহাভোজের দায়িত্বে, সেই ‘কেটারার’ বাবলু কুণ্ডুকে দেখা গেল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় শুকনো মুখে অতিরিক্ত জেলাশাসকের দফতরের সামনে দাঁড়িয়ে। তখনও পাকা অর্ডার হাতে পাননি। বাবলু বলেন, ‘‘অর্ডারই পাইনি। কত খরচ দাঁড়াবে, বুঝছি না।’’

পাখা-আলো-মাইক জোগানোর ভার যাঁর উপরে, তাঁকে দুপুরের পরে হঠাৎই গোটা চার-পাঁচেক টার্বো এসি জোগাড় করতে বলা হয়েছে। দুপুরের বৈঠকের পরে বিকেল ৪টেয় মুখ্যমন্ত্রী পুলিশ লাইনে যে প্রকাশ্য সমাবেশ করবেন, সেই মঞ্চে লাগানো হচ্ছে। সেই মঞ্চের পিছনে শুধু মুখ্যমন্ত্রীর জন্যই গড়া হয়েছে অস্থায়ী শৌচাগার (বাকিদের ব্যবস্থা আলাদা)। তাতে দু’টি সাবান, শ্যাম্পু, হ্যান্ডওয়াশ, দু’টি টাওয়েল, পাউডার, দু’টি বডি স্প্রে, এমনকী লেডিজ ছাতাও মজুত!

কী হবে ওই সমাবেশে?

জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, নানা সরকারি প্রকল্পে একশো উপভোক্তার হাতে সাহায্য তুলে দেবেন মুখ্যমন্ত্রী। উদ্বোধন হবে ‘স্মার্ট বর্ধমান’ মোবাইল অ্যাপের। বর্ধমান জেলা সম্প্রতি যে আইএসও ৯০০১ শংসাপত্র পেয়েছে, সেটি মুখ্যমন্ত্রীর হাতে তুলে দেবেন জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন। ১৩২ কোটি টাকার ৫৬টি প্রকল্পের শিলান্যাস এবং ৫১টি প্রকল্পের উদ্বোধন হওয়ার কথাও রয়েছে। তবে তা কেটে-ছেঁটে পাক্কা ১০০-য় নামানো হতে পারে। ‘তাঁতি সাথি’ নামে নতুন প্রকল্পেরও ঘোষণা করার কথা মমতার।

এই ‘ঐতিহাসিক’ সভা (‌জেলার এক বড়কর্তার কথায়) প্রত্যক্ষ করতে কলকাতা থেকে গাড়ি ও দু’টি ভলভো বাসে মন্ত্রী, সচিব ও অন্য প্রতিনিধিরা আসছেন। জেলার বিভিন্ন ব্লক থেকে বিভিন্ন প্রকল্পের উপভোক্তাদের শহরে আনতে পরিবহণ দফতরের মাধ্যমে ৬০০ বাস চেয়েছে জেলা প্রশাসন। সেগুলি ১৮টি জায়গায় দাঁড়াবে। পুলিশ লাইনে পানীয় ও শৌচের জল জোগাতে দু’টি নতুন ট্যাঙ্ক লাগানো হয়েছে। বসেছে সাবমার্সিবল পাম্পও।

ম্যারাপ, তিনটি মঞ্চ, তোরণ, ফ্লেক্স, চেয়ার-টেবিল জোগানোর ভার পাঁচ ডেকরেটরের উপরে। আগে বর্ধমানেই ‘মাটিতীর্থ কৃষিকথা’ উৎসবের কাজও এঁরাই করেছিলেন। তাঁদের সংশয়, ‘‘সে বার দু’মাসে টাকা পাই। কেন্দ্রীয় প্রকল্প ‘আত্মা’ থেকে টাকা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এ বার মনে হচ্ছে, টাকা পেতে দেরি হবে। টাকা আদৌ মজুত আছে কি না, কে জানে?’’ এত টাকা জোগাচ্ছে কে?

উত্তর মেলেনি। বরাদ্দ সংক্রান্ত প্রশ্ন এড়িয়ে জেলাশাসক শুধু বলেন, ‘‘আমি ব্যস্ত রয়েছি।’’ মুচকি হেসে জবাব দেন জেলার আর এক কর্তা— ‘টাকা যে দেয়, গৌরী সেন!’ ভুক্তভোগীরা বলছেন, গোটা ব্যাপারটাই আসলে ‘ধার করে ঘি খাওয়া’র গল্প। সে ধার সরকার কত দিনে মেটাবে, কবে সত্যি হাতে টাকা আসবে, কেউ জানে না।

কিন্তু তাঁদের চেয়েও খারাপ অবস্থা রাজ্য সরকারের সেই কর্মীদের, যাঁরা কোনও না কোনও ভাবে এই সভায় থাকছেন, দুপুরে খাচ্ছেন— সে বুফেই হোক বা প্যাকেট। ৪৮% মহার্ঘ্য ভাতা বাকি। চিংড়ি-ইলিশ-পাঁঠা বা নিতান্ত ভেজ স্যান্ডুইচও তাঁদের গলা দিয়ে নামবে তো?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন