প্রতীকী চিত্র।
বিহারের মধুবনীর এক আনকোরা বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ। ১৫০ আসনের সেই কলেজে ছাত্র-ভর্তির অনুমতি পেতে ‘মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া’(এমসিআই)-র বোর্ড অব গভর্নর্সের ছাড়পত্র দরকার। অথচ, সেই কলেজের অ্যানাটমি বিভাগের ভাঁড়ারে যথেষ্ট সংখ্যক ‘ক্যাডাভার’ বা মৃতদেহ নেই। ফলে ছাড়পত্র পাওয়া মুশকিল। সাত তাড়াতাড়ি দেহ সংগ্রহ করে ওই কলেজ যাতে এমসিআই-এর সবুজ সঙ্কেত পেতে পারে, নজিরবিহীন ভাবে সেই দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য দফতর!
মধুবনী মেডিক্যাল কলেজ নামে ওই বেসরকারি কলেজকে এ রাজ্যের চার সরকারি মেডিক্যাল কলেজের (এসএসকেএম, কলকাতা মেডিক্যাল, এনআরএস ও ন্যাশনাল মেডিক্যাল) ভাঁড়ার থেকে মৃতদেহ দিয়ে দেওয়ার নির্দেশ গত সপ্তাহে জারি করেছিলেন খোদ স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা বা ডিএমই! সেই নির্দেশ মেনে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ অ্যানাটমি বিভাগ থেকে দু’টি মৃতদেহ দিয়েও দেয়। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ হওয়ায় ডিএমই-র নির্দেশিকা পেয়েও মৃতদেহ দিতে চাননি এসএসকেএমের অ্যানাটমি বিভাগের চিকিৎসকেরা। তবে ন্যাশনালের দেওয়া ওই দেহ দু’টি শেষ পর্যন্ত কোথায় গেল, তা জানা যায়নি। মধুবনীর ওই কলেজ জানিয়েছে, কলকাতার কোনও দেহ তাদের কাছে পৌঁছয়নি।
এসএসকেএমের অ্যানাটমি বিভাগের চিকিৎসকেরা জানান, মৃতদেহ ওই ভাবে দিয়ে দেওয়াটা আইনসম্মত কি না বা বিষয়টির মধ্যে কতটা স্বচ্ছতা রয়েছে, সে প্রশ্ন তুলে গত শুক্রবার তাঁরা হাসপাতালের অধিকর্তাকে ঘটনাটি জানান। খবর যায় স্বাস্থ্য ভবনে। তুলকালাম শুরু হয়। প্রশ্ন ওঠে, লোকে হাসপাতালে মরণোত্তর দেহদান করেন মেডিক্যালের পঠনপাঠনের স্বার্থে। সেই দেহ কি কখনও এমসিআই-এর পরিদর্শকদের দেখিয়ে ছাত্র-ভর্তির ছাড়পত্র আদায়ে ব্যবহৃত হতে পারে? তা ছাড়া, ভিন্ রাজ্যের বেসরকারি কলেজকে কি সেই রাজ্যের সরকারের হস্তক্ষেপ ছাড়াই এ রাজ্যের সরকারি মেডিক্যাল কলেজ থেকে মৃতদেহ পাঠানো যায়?
বিষয়টি যে আইনসম্মত হয়নি, তা কার্যত স্বীকার করে নিয়েছেন রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা প্রদীপ মিত্র। তিনি বলেন, ‘‘অনেক সময়ে ভিন্ রাজ্যের মেডিক্যাল কলেজে পঠনপাঠনের জন্য এ রাজ্য থেকে মৃতদেহ পাঠানো হয়। কারণ, আমাদের অনেক হাসপাতালেই দেহ উদ্বৃত্ত হয়। কিন্তু নথি ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, মধুবনী মেডিক্যাল কলেজ অর্ধসত্য জানিয়েছিল। তারা বলেছিল, মৃতদেহ লাগবে। কিন্তু তাদের কলেজ যে এখনও চালুই হয়নি এবং পঠনপাঠনের জন্য নয়, শুধু এমসিআই-কে দেখানোর জন্যই যে দেহ দরকার, এটা আমাদের জানানো হয়নি।’’
প্রদীপবাবুকে জিজ্ঞাসা করা হয়, সরকারি নির্দেশ জারির আগে আবেদনকারী কলেজ সম্পর্কে কি খোঁজ নেওয়া হয় না? উত্তরে তিনি বলেন, ‘‘বহু আবেদন প্রতিদিন আসছে। সব খুঁটিয়ে খোঁজ নেওয়া অসম্ভব। তবে এই ঘটনায় আমাদের একটা বড় শিক্ষা হল। এর পর থেকে কেউ মৃতদেহ চাইলে সেই মেডিক্যাল কলেজ সম্পর্কে খবর নেওয়া হবে। আপাতত আমি আগের নির্দেশিকা প্রত্যাহার করে নতুন করে নির্দেশ দিয়েছি। কোনও মেডিক্যাল কলেজ যেন মধুবনী মেডিক্যাল কলেজকে আর কোনও মৃতদেহ না দেয়, তা বলে দেওয়া হয়েছে।’’
যাঁরা এই বিষয়টি নিয়ে স্বাস্থ্য দফতরকে প্রথম সতর্ক করেন, সেই এসএসকেএমের অ্যানাটমি বিভাগের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, গত শুক্রবার সান্টু মল্লিক নামে এক জন তাঁদের বিভাগে এসে ডিএমই-র নির্দেশিকা দেখিয়ে মৃতদেহ চান। তিনি মধুবনী মেডিক্যাল কলেজের যে ‘অথরাইজেশন লেটার’ দেখিয়েছিলেন, সেটি একটি প্রতিলিপি। আর সেখানে তাঁর ঠিকানা লেখা ছিল, ৮৮, কলেজ স্ট্রিট। তাতেই চিকিৎসকদের সন্দেহ হয়। কারণ, ওই ঠিকানা কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের। তা ছাড়া, মধুবনী মেডিক্যাল কলেজের কোনও কর্তাও সঙ্গে ছিলেন না।
এসএসকেএমের চিকিৎসকেরা রাজি হচ্ছেন না দেখে আসরে অবতীর্ণ হন সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজের এক ডোম। তিনি মৃতদেহ দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন। মধুবনী মেডিক্যালের জন্য সাগর দত্তের এক ডোমের এমন আগ্রহ দেখে চিকিৎসকদের সন্দেহ আরও গাঢ় হয়। তাঁরা তখন বিষয়টি অধিকর্তাকে জানান।
মধুবনী মেডিক্যাল কলেজে মঙ্গলবার যোগাযোগ করা হলে সেখানকার অধ্যক্ষ রবীন্দ্রকুমার সিংহ বলেন, ‘‘এই হাসপাতাল ‘মিল্লি ট্রাস্ট’ নামে একটি ট্রাস্টের অন্তর্ভুক্ত। ট্রাস্টই পশ্চিমবঙ্গের ডিএমই-র সঙ্গে যোগাযোগ করে। আমরা দু’-তিন জন লোককে বরাত দিয়েছিলাম দেহগুলি নিয়ে আসার জন্য। মঙ্গলবারই এমসিআই-এর পরিদর্শন হয়ে গিয়েছে। আর দেহ দরকার নেই।’’