নিজের আবাসনে মহেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: তাপস ঘোষ।
‘প্রবীণ নাগরিক দিবসেই’ নিজের মেয়ে-জামাইয়ের বিরুদ্ধে তাঁকে গৃহবন্দি করে রাখার অভিযোগ তুললেন অবসরপ্রাপ্ত এক প্রবীণ কলেজ শিক্ষক।
মানকুণ্ডুর ঝিল পার্ক লাগোয়া একটি আবাসনের বাসিন্দা ওই বৃদ্ধের অভিযোগ, আট মাস ধরে তিনি গৃহবন্দি। শুধু তা-ই নয়, মেয়ে-জামাইয়ের নামে মারধর, গালিগালাজের অভিযোগও এনেছেন বৃদ্ধ। বাইরের কারও সঙ্গে তিনি যাতে যোগাযোগ রাখতে না পারেন, তার জন্য তাঁর মোবাইল ফোনও মেয়ে-জামাই কেড়ে নিয়েছে বলে দাবি করেছেন বৃদ্ধ। কোনও ক্রমে নিজের এই অসহায় পরিস্থিতির কথা জানিয়ে চন্দননগর আইনি সহায়তা কেন্দ্রে তাঁর এক পরিচিতের মারফত চিঠি পাঠান তিনি। সেই চিঠির সূত্র ধরেই বিষয়টি নজরে আসে প্রশাসনের।
হুগলি জেলা প্রশাসনের তরফে এক মহিলা অফিসার বৃদ্ধের হাল-হকিকত খতিয়ে দেখতে ওই আবাসনে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর পরিচয়পত্র দেখার অছিলায় ওই বৃদ্ধের মেয়ে তাঁর সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছেন বলে প্রশাসন সূত্রে খবর। শেষ পর্যন্ত জেলা প্রশাসনের তরফে বিষয়টি ভদ্রেশ্বর থানায় জানানো হয়। পুলিশও ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে। চন্দননগরের মহকুমাশাসক দেবাশিস বিশ্বাস বলেন, ‘‘বিষয়টি প্রশাসনের নজরে আছে। তদন্ত হচ্ছে।’’
মহেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় নামে ওই বৃদ্ধ হুগলি মহসিন কলেজে শিক্ষকতা করতেন। বর্তমানে তাঁর বয়স ৮৬ বছর। লিখিত অভিযোগের ছত্রে ছত্রে তাঁর উপর মেয়ে এবং জামাইয়ের অত্যাচারের কথা জানিয়েছেন তিনি।
মহেন্দ্রনাথবাবু লিখেছেন, ‘‘আমাকে গৃহভৃত্যে পরিণত করা হয়েছে। ওদের একটি মেয়ে আছে। তার দেখাশোনার ভার আমার উপর দিয়ে ওরা নিশ্চিন্তে আছে। বাচ্চাটার ঠিক মতো দেখাশোনা করতে পারি না এই অজুহাতে আমাকে মারধর করে ওরা। অকথ্য, অশ্লীল গালাগালি দেয়। আমি Domestic Violence এর শিকার। আমাকে তালা চাবি দিয়ে ঘরে আটকে রাখে। বাইরে মোটেই যেতে দেয় না। পাছে বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাই, তাই এই অবস্থা করেছে।’’
ওই বৃদ্ধের আরও অভিযোগ, তাঁর মেয়ে-জামাই মাঝে মাঝে নাতনির কথা বলে তাঁকে প্রতিশ্রুতি দেয় যে, মারধর বা অত্যাচারের ঘটনা তাঁর উপর আর হবে না। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের স্পষ্ট অভিযোগও তিনি তাঁর চিঠিতে উল্লেখ করেছেন। তাঁর অন্যতম অভিযোগ, ‘‘ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, প্যান কার্ড, ব্যাঙ্ক, এলআইসি-র সমস্ত নথি কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এটিএম কার্ডের পিনও নিয়ে নিয়েছে ওরা। খালি চেক বইয়ে সই করিয়ে নেয়।’’
প্রবীণ ওই শিক্ষক মেয়ে-জামাইয়ের বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ এনেছেন ওই আবাসনের অন্য আবাসিকরা তার কিছুই অস্বীকার করেননি। তাঁদের কথায়, ‘‘দীর্ঘদিন ধরে ওই বৃদ্ধকে বাইরে দেখতে পাই না। তবে মাঝেমঝেই তাঁর আর্তনাদ শুনি। বিষয়টি একান্তই পারিবারিক বলে আমরা হস্তক্ষেপ করার কোনও সুযোগ পাইনি।’’
ওই বৃদ্ধের জামাই দেবাশিস দাস প্রবীণ ওই শিক্ষককে গৃহবন্দি করে রাখার বিষয়টি অবশ্য অস্বীকার করেননি। তাঁর দাবি, ‘‘বাবা মাঝে মধ্যেই এখান থেকে বৃদ্ধাশ্রমে চলে যেতে চান। মাঝে এক বার চলেও গিয়েছিলেন। আমরাই ওঁকে ফিরিয়ে আনি। আমরা বাড়িতে ওঁর যে ভাবে দেখাশোনা করি, বৃদ্ধাশ্রমে কি সেটা সম্ভব ?’’ ওই আবাসনের এক আবাসিক অবশ্য বলেন, ‘‘একজন বৃদ্ধের উপর দিনের পর দিন অত্যাচার হলে উনি যে পালিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে চাইবেন, তার মধ্যে তো কোনও অস্বাভাবিকতা নেই। উনি এখনও ২৫ হাজার টাকা পেনশন পান।’’
দেবাশিসবাবু মেনে নিয়েছেন যে, বৃদ্ধের আর্থিক লেনদেন তাঁরাই করেন। তিনি বলেন,‘‘এই বয়সে ওঁর বাইরে যাতায়াত করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া ওঁর চিকিৎসার খরচ অনেক বেশি। সেই কারণেই আমরা ওঁর টাকাতেই চিকিৎসা করি।’’ কিন্তু মারধর? এ বার থমকে যান দেবাশিসবাবু। আমতা আমতা করে বলেন, ‘‘বৃদ্ধ মানুষ অনেক সময় অবুঝ হন। বকাবকি আমরা কিছুটা করি। কিন্তু মারধর কখনওই করি না।’’ দেবাশিসবাবুর কথাবার্তার মাঝখানেই বৃদ্ধ শ্বশুরমশাই জামাইকে আঙুল উঁচিয়ে থামিয়ে দেন। বলে ওঠেন— ‘‘মিথ্যা বোলো না।’’
এ দিন ওই আবাসনে গিয়ে ব়ৃদ্ধের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে দেবাশিসবাবু প্রথমে রাজি হননি। তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি ‘অসুস্থ’ বলে জানান। তবে অনেক অনুরোধের পরে ওই আবাসনে গিয়ে মহেন্দ্রবাবুর দেখা মেলে। ছবি তুলতে আগ্রহী প্রবীণ রীতিমতো চুল আঁচড়ে পোজও দেন।
কী চান আপনি? বৃদ্ধ জানান, তিনি এখন ‘মুক্তি’ চাইছেন। দেবাশিসবাবুকে সে কথা জিজ্ঞাসা করতেই তিনি বলে ওঠেন, ‘‘প্রশাসন দায়িত্ব নিতে চাইলে আমরা রাজি।’’