বাংলার রাজনীতিতে এই ফ্রেম ছিল অত্যন্ত পরিচিত। —ফাইল চিত্র।
মহাজাতি সদনের দোতলার ঘরটায় যখন ফিরলাম, তখন রাত অনেকটাই। সারা দিন কোথায় কোথায় ছুটেছি, তার ঠিক নেই। রাতে যখন ফিরেছি, তখন হা-ক্লান্ত, আর শরীর চলছে না। খিদেয় পেট জ্বলে যাচ্ছে। কিন্তু দুই ব্যাচেলরের অস্থায়ী সংসার, দু’জনেই দিনভর ঘরছাড়া ছিলাম। অত রাতে আদৌ কোনও খাবার জুটবে কি না, জানি না।
আসলে ভুলেই গিয়েছিলাম, প্রিয়দা’র সংসারে রয়েছি, সুতরাং দুশ্চিন্তার কোনও মানেই হয় না। দিনভর সাংগঠনিক কাজে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত প্রিয়দা-ও ছুটেছেন। কিন্তু ফিরে এসে প্রেশার কুকারে রান্নাটাও সময় মতো সেরে ফেলেছেন। খিদের মুখে প্রিয়দার সেই রান্না তখন যেন অমৃত।
ঠিক এই ভাবেই অভিভাবকের মতো আগলে রাখতেন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। প্রিয়দা এবং আমার নাম একসঙ্গে উচ্চারণ করা হত বটে, ‘প্রিয়-সুব্রত’ খুব পরিচিত শব্দবন্ধ ছিল সে সময়ের বাংলায়। কিন্তু প্রিয়দা অনেক বড় মানুষ ছিলেন, তিনি আমার অভিভাভক ছিলেন।
আমি কিন্তু পারিবারিক সূত্রে রাজনীতিতে আসিনি, আমি সক্রিয় রাজনীতিতে এসেছিলাম প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির প্রভাবেই। যখন বঙ্গবাসী কলেজে পড়ি, তখন থেকেই প্রিয়দা’র অনুগামী। তবে তখনও প্রিয়দা’র খুব কাছে যেতে পারিনি। নেতা হিসেবে খুব শ্রদ্ধা করতাম, আলাপ-পরিচয়ও হয়ে গিয়েছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির খুব কাছাকাছি চলে এলাম। আমার উপর খুব ভরসা করতেন। অনেক কাজের দায়িত্ব আমার উপর ছেড়ে নিশ্চিন্ত হতেন। ছাত্রনেতারাই তখন রাজ্যের রাজনীতিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। কংগ্রেস, সিপিএম, নকশাল— সব শিবিরেই তখন ছাত্র রাজনীতির জোয়ার। আমরা বাংলায় কংগ্রেসকে ক্ষমতায় ফেরানোর জন্য জোর লড়াই শুরু করেছি। গোটা রাজ্যে ছুটে বেড়াচ্ছি। আর যাবতীয় কার্যকলাপের ভরকেন্দ্র ওই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। সেই সময়টাতেই মহাজাতি সদনের দোতলার একটা ঘরে প্রিয়দা’র সঙ্গে থাকতাম। সারা দিন দৌড়ঝাঁপের পরেও প্রিয়দা-ই কিন্তু ঘরে ফিরে রান্নাটা করতেন।
একসঙ্গে উচ্চারিত হত দু’জনের নাম— প্রিয়-সুব্রত। রাজনৈতিক বিচ্ছেদ কয়েক বার হয়েছে,
কিন্তু প্রিয়রঞ্জনের সঙ্গে সুব্রতর বিচ্ছেদ কখনও হয়নি। বললেন সুব্রত নিজেই। —ফাইল চিত্র।
নকশাল আমল, ভয়ঙ্কর একটা সময়। প্রিয়দা আর আমি একই সঙ্গে সেই ভয়াবহ দুর্দিনের মুখোমুখি হয়েছি, একসঙ্গে লড়েছি। রোজ কোথাও না কোথাও কংগ্রেসের উপর আক্রমণের খবর, রোজ কোনও না কোনও প্রান্তে খুন হচ্ছেন কংগ্রেস কর্মীরা। প্রায় আড়াই-তিন হাজার কর্মীকে খুন হতে দেখেছি সেই কয়েকটা বছরে। প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি রোজ ছুটে যেতেন খুন হয়ে যাওয়া কর্মী-সমর্থকদের পরিবার-পরিজনের কাছে, সমবেদনা জানাতেন, পাশে থাকার আশ্বাস দিয়ে আসতেন। আমাকেও পাঠিয়ে দিতেন অন্য কোনও দিকে, অন্য কারও পাশে দাঁড়াতে। আক্রমণের মুখে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে প্রিয়দা আর আমি ছুটে বেড়াতাম গোটা রাজ্যে, রোজ। সেই থেকেই প্রিয়-সুব্রত নাম দুটো জুড়ে গিয়েছিল। একসঙ্গে খেতাম, একসঙ্গে থাকতাম, একই জামা-কাপড় পড়তাম, একই জুতো পরতাম, পায়ের মাপও একই ছিল। সম্পর্কটা এই রকমই ছিল। এমন এক জন নেতা তথা রাজনৈতিক সহকর্মী তথা অভিভাবক চিরতরে চলে গেলেন। আমার কেমন লাগছে, সে আর কী ভাবে বলব, জানি না।
আরও পড়ুন: প্রয়াত প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি
প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির সঙ্গে আমার রাজনৈতিক বিচ্ছেদও হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই খুব কঠিন সিদ্ধান্ত ছিল আমার পক্ষে। খুব কঠিন দিন ছিল। আমাকে বেছে নিতে হয়েছিল— ইন্দিরা গাঁধী, নাকি প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। শেষ পর্যন্ত ইন্দিরা গাঁধীকেই বেছে নিয়েছিলাম। দু’জনেই খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। কিন্তু দু’জনেই বুঝেছিলাম, পরস্পরের বাধ্যবাধকতা। ফলে আমার আর প্রিয়দার ব্যক্তিগত সম্পর্কে কখনও কোনও ছাপ পড়েনি। আলাদা দলে থেকেছি ঠিকই, কিন্তু কখনও আমি প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির থেকে আলাদা হইনি, প্রিয়-সুব্রত একই থেকেছে।
আরও পড়ুন: রাহুলকে সভাপতি করার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেল কংগ্রেসে
পরে আবার প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি আর আমি এক ছাতার তলায় ফিরেছি, ইন্দিরা গাঁধীর কংগ্রেসেই থেকেছি। আবার প্রিয়দার সঙ্গেই কাজ করেছি। কংগ্রেস ছেড়ে এক সময়ে তৃণমূলে যোগ দিই, কলকাতার মেয়র হই। কিন্তু প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির জন্য আবার কংগ্রেসে ফিরি। প্রিয়দা তার পর যত দিন সক্রিয় রাজনীতিতে থেকেছেন, তত দিনই কিন্তু আমি প্রিয়দার সঙ্গেই থেকেছি। আজ আমার দ্বিতীয় বার পিতৃবিয়োগ হয়েছে।