ক্ষতিপূরণের দাবি মাওবাদী বুলেটে অকেজো জীবনের

ঘুমের মধ্যে অনেক সময়ে চাপ পড়ে যায় বাঁ হাতে। আর তখনই যন্ত্রণায় কাতরে উঠে জেগে যান মনসারাম সর্দার। লালগড়ের ডাইনটিকরি গ্রামের ঊনচল্লিশ বছরের মনসারাম হাফ হাতা জামা বা টি-শার্ট পরেন না। বাঁ হাতের ক্ষত ঢাকতে। দেখলে মনে হয়, কনুইয়ের কাছে হিংস্র জন্তু খুবলে দিয়েছিল। আসলে মাওবাদী হিংসার ছোবল।

Advertisement

সুরবেক বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৫ ১৭:১৬
Share:

মনসারাম সর্দার। নিজস্ব চিত্র।

ঘুমের মধ্যে অনেক সময়ে চাপ পড়ে যায় বাঁ হাতে। আর তখনই যন্ত্রণায় কাতরে উঠে জেগে যান মনসারাম সর্দার।

Advertisement

লালগড়ের ডাইনটিকরি গ্রামের ঊনচল্লিশ বছরের মনসারাম হাফ হাতা জামা বা টি-শার্ট পরেন না। বাঁ হাতের ক্ষত ঢাকতে। দেখলে মনে হয়, কনুইয়ের কাছে হিংস্র জন্তু খুবলে দিয়েছিল। আসলে মাওবাদী হিংসার ছোবল। ২০১০-এর ৩ ফেব্রুয়ারি দোনলা বন্দুক থেকে পর পর ছোড়া মাওবাদীদের দু’টো গুলি ঢোকে ওই হাতে। পরে একাধিক অস্ত্রোপচার। দিনমজুর মনসারামের কথায়, ‘‘বাঁ হাতটা একেবারে অচল। হাতটা কাটা যায়নি। কিন্তু থেকেও নেই।’’

একই ভাবে, বাঁ হাতে হাল্কা কাজও করতে পারেন না বোনিশোল গ্রামের জিতেন মাহাতো। বাঁ পাশ ফিরে শুতেও পারেন না। তাঁর অবশ্য বাঁ হাতটা অক্ষত। কিন্তু মাওবাদীদের সেল্ফ লোডিং রাইফেলের গুলি তাঁর পিঠের বাঁ দিকে ঢুকে বাঁ কাঁধ ফুঁড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল ২০০৯-এর জুনে। কাঁধের একটা হাড় কেটে বাদ দেওয়ার ফলে বাঁ হাতটা অকেজো।

Advertisement

গোয়ালডাঙার শ্রীদাম মণ্ডলের আবার অন্য সমস্যা। শ্বাসপ্রশ্বাসের কষ্ট লেগেই আছে, আর মাঝেমধ্যেই বুকে-পিঠে তীব্র জ্বলুনি হয়। প্রবীণ শ্রীদামবাবুর বুকে মাওবাদীরা গুলি করেছিল পাঁচ বছর আগে।

শ্রীদামবাবু, জিতেন, মনসারাম-সহ লালগড়ের ন’-দশ জন লিখিত ভাবে আর্থিক সাহায্য চেয়ে কাতর আর্তি জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। মঙ্গলবার তাঁদের ওই চিঠি নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর দফতরে পৌঁছেছে।

এঁদের প্রত্যেকেরই কর্মক্ষমতা কমে অর্ধেক কিংবা আরও কম হয়ে গিয়েছে। প্রাণে বাঁচতে চিকিৎসার জন্য কয়েক লক্ষ টাকা করে খরচ হয়েছে সবার। কেউ জমি বেচেছেন, কেউ স্ত্রীর গয়না বিক্রি করে দিয়েছেন এবং সেই সঙ্গে মাথায় বিপুল পরিমাণ ধারের বোঝা। তার পরেও কেউ কেউ মাঝপথে চিকিৎসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন অর্থাভাবে।

এই অবস্থায় মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে মাওবাদী হামলার শিকার ওই দুর্গতেরা বলেছেন, ‘আপনার সরকার। মাওবাদীদের মধ্যে যারা আত্মসমর্পণ করেনি, তাদেরও পুনর্বাসন প্যাকেজ দেওয়ার বিজ্ঞপ্তি জারি করেছেন। এমনকী, মাওবাদী বা মাওবাদীদের সমর্থক যাদের বিরুদ্ধে পুলিশের খাতায় মামলা নেই, তাদেরও নাকি এই পুনর্বাসন প্যাকেজের সুবিধে দেওয়া হবে।’

মাওবাদীদের গুলিতে ওই আহতদের প্রশ্ন, ‘‘সে ক্ষেত্রে আমরা যারা মাওবাদীদের হাতে জখম হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত, আর্থিক ভাবে বিপর্যস্ত এবং শারীরিক ভাবে অসুস্থ ও কর্মক্ষমতাহীন, তারা কি আপনার সরকারের দয়া থেকে বঞ্চিত হব?’’

স্বরাষ্ট্র দফতরের একটি নথি থেকে জানা যাচ্ছে, আত্মসমর্পণকারী মাওবাদীদের বিভিন্ন প্রকল্পের অধীনে দেওয়া মোট আর্থিক সাহায্যের পরিমাণ ২০১৪-র মে পর্যন্ত ১ কোটি ৫০ হাজার ৮৫০ টাকা।

আবার এই বছর ৩০ সেপ্টেম্বর মাওবাদীদের জন্য আত্মসমর্পণ ও পুনর্বাসন নীতি শিথিল হওয়ার পর বুধবারই জঙ্গলমহলের ৮৬ জনকে প্যাকেজ দেওয়া হয়েছে। এদের অনেকেরই বিরুদ্ধে পুলিশের খাতায় মামলা নেই এবং এরা আত্মসমর্পণও করেননি। সোমবারই অবশ্য সরকার ওই ঘোষণা করেছিল।

এই প্রেক্ষাপটে মাওবাদীদের হাতে নিহত কয়েক জন ও নিহত বলে সন্দেহ কিন্তু এখনও খাতায়-কলমে নিখোঁজ, এমন কয়েক জনের ক্ষতিগ্রস্ত ও অসহায় পরিবার প্রশ্ন তুলেছেন, ধৃত মাওবাদী ও তাদের লিঙ্কম্যানেরাও যেখানে সরকারি চাকরি পাচ্ছে, সেখানে তাঁদের বঞ্চিত করা হচ্ছে কেন? কেবল সরকারের দেওয়া ক্ষতিপূরণের টাকায় সঙ্কট মিটছে না বলে তাঁরা জানাচ্ছেন।

ঘটনাচক্রে, মাওবাদীদের হামলায় জখম হয়ে ক্ষতিগ্রস্তরা প্রায় একই সময়ে সরকারি সাহায্য চেয়ে আবেদন করলেন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে।

লালগড়ের পাঁপুড়িয়া গ্রামের উজ্জ্বল কুণ্ডুকে ছ’বছর আগে হাতে ও পায়ে গুলি করেছিল মাওবাদীরা। পেশায় কৃষক উজ্জ্বলবাবু লাখ দুয়েক টাকা খরচ করে প্রাণে বেঁচেছেন, কিন্তু এখনও ভাল করে হাঁটতে পারেন না। উজ্জ্বলবাবুর কথায়, ‘‘আগে যা কাজ করতাম, গুলি লাগার পর তার অর্ধেকও পারি না। রোজগারও তাই কমে গিয়েছে। দেনা শোধ করতে পারছি না। সরকারি সাহায্য পেলে একটু মাথা তুলে বাঁচতে পারতাম।’’

একই বক্তব্য ঝাঁটিবনির অজিত হেমব্রম, জিরাপাড়ার ত্রিলোচন সামন্তের। তাঁরা জানান, যবে থেকে একটু হাঁচাটলা করতে পারছেন, তখন থেকে বার বার স্থানীয় থানা, ব্লক প্রশাসন, জেলা পুলিশ ও প্রশাসনের সদর দফতরে গিয়ে বার বার আবেদন জানিয়েও কাজ হয়নি, তাই শেষমেশ মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন।

যাতে তাঁরা বলছেন, অনেক সময়েই পাওনাদারদের অপমান এবং পরিবারের প্রতি কর্তব্য পালন না করার যন্ত্রণা পোহাতে হচ্ছে।

তবে রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তার কথায়, ‘‘মাওবাদীদের হাতে নিহতদের পরিবারকে আর্থিক সাহায্য দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। জঙ্গলমহলের বহু পরিবার সেই সাহায্য ইতিমধ্যেই পেয়েছেন। এককালীন অর্থসাহায্য দেওয়া হয়েছে তাঁদের। তবে আহতদের পরিবারকে সেই সাহায্য দেওয়ার সরকারি নীতি নেই।’’ তিনি জানান, মাওবাদীদের পুনর্বাসন ও মাওবাদীদের হাতে নিহতদের ক্ষতিপূরণের টাকার বড় অংশ দিচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার।

স্বরাষ্ট্র দফতর সূত্রের খবর, এই বছরের গোড়ায় রাজ্য সরকার মাওবাদী হামলায় নিহতদের পরিবার পিছু আট লক্ষ টাকা এককাকালীন সাহায্য দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে রাজ্যের ভাগ অর্ধেক। বাকি চার লক্ষের তিন লক্ষ কেন্দ্রীয় সরকার দিচ্ছে বিশেষ প্রকল্প থেকে, এক লক্ষ সিকিওরিটি রিলেটেড এক্সপেনডিচার (এসআরই) স্কিম থেকে।

মাওবাদী হামলায় লালগড়ের ওই আহতরা চিঠিতে লিখেছেন, এর চেয়ে মাওবাদীদের হাতে খুন হয়ে গেলেই ভাল হত, পরিবারও আর্থিক সাহায্য পেত, গলগ্রহ হয়ে বাঁচতে হত না।

তবে নবান্ন সূত্রে জানা গিয়েছে, এসআরই স্কিমে মাওবাদী হামলায় প্রতিবন্ধীদের জন্য আর্থিক সাহায্য দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। তবে পশ্চিমবঙ্গের কেউ এখনও সেই সাহায্য পাননি বলে স্বরাষ্ট্র দফতর সূত্রের খবর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন