জঙ্গলমহল আর সত্যিই এখন হাসছে কি না— প্রশ্ন তুলে দিল খোদ রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা-রিপোর্টই।
ওই রিপোর্ট অনুযায়ী এ বার আর নিছক স্কোয়াডের ‘আনাগোনা’ কিংবা জঙ্গল ঘেঁষা গ্রামে মিটিং করার মতো ‘গোপন কার্যকলাপ’ নয়। মাওবাদীরা ফের তোলা চেয়ে ব্যবসায়ীদের হুমকি-চিঠি দেওয়াও শুরু করেছে, যা বন্ধ ছিল বছর চারেক। মাওবাদী স্কোয়াডের সদস্যরা দল বেঁধে এসে এই এলাকায় থেকেও যাচ্ছে।
রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা শাখা বা ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চ (আইবি)-ই এই মর্মে তাঁদের সুনির্দিষ্ট ভাবে তথ্য দিয়েছে বলে জানাচ্ছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। একই তথ্য পৌঁছেছে সিআরপি-র হাতেও।
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এসআইবি (সাবসিডিয়ারি ইনটেলিজেন্স ব্যুরো) সূত্রের খবর, গত ১৮ জুন রাজ্য গোয়েন্দা শাখা-র আইজি শশীকান্ত পূজারী (বার্তার মেমো নম্বর— ১৯১/১১/এলডব্লিউই) জানিয়েছেন, মাওবাদীরা পুরুলিয়ার বলরামপুর এলাকার দু’জন ইটভাটা মালিকের কাছ থেকে তোলা চেয়ে চিঠি দিয়েছে। ওই দুই ব্যবসায়ীর নাম গোপাল অগ্রবাল ও গোপাল মণ্ডল। এসআইবি-র যুগ্ম অধিকর্তা নীরজ সিংহের পাশাপাশি সিআরপি-র আইজি বিবেক সহায়কেও পাঠানো হয়েছে রাজ্য পুলিশের ওই তথ্য।
এটাই শেষ নয়। গত ৩ জুন কলকাতায় বিভিন্ন কেন্দ্রীয় ও রাজ্য গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয় কমিটি (সাবসিডিয়ারি মাল্টি এজেন্সি সেন্টার বা স্ম্যাক)-র বৈঠকেও পেশ হওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে তৈরি রিপোর্টের মূল বক্তব্য ছিল— ‘পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলে ফের সক্রিয় হচ্ছে মাওবাদীরা।’
পুরুলিয়া জেলা পরিষদের সভাধিপতি তথা বলরামপুরে তৃণমূলের ব্লক সভাপতি সৃষ্টিধর মাহাতোও স্বীকার করে নিচ্ছেন, ‘‘বলরামপুর টাউনের বাসিন্দা দু’জন ইটভাটা মালিকের কাছ থেকে টাকা চেয়ে চিঠি দিয়েছে মাওবাদীরা। ওঁদের ইটভাটাগুলো বলরামপুর থেকে কিছুটা দূরে পাড়বাঁইধ ও খেকরিডি তল্লাটে। সেখানেই হুমকি-চিঠি রেখে যাওয়া হয়েছে।’’ সৃষ্টিধরের সন্দেহ, ‘‘বলরামপুর এলাকায় ঘোরাঘুরি করছে বীরেন সিংহ সর্দারের মাওবাদী-স্কোয়াড। যার নেতৃত্বে রয়েছে এই তল্লাটেরই বাসিন্দা হলধর গরাই। এটা সম্ভবত ওদেরই কাজ।’’
গোয়েন্দা সূত্রের খবর, ওই দুই সম্পন্ন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে লক্ষাধিক টাকা চাওয়া হয়েছে। শাসক দল ও পুলিশ অবশ্য নিরাপত্তার ব্যাপারে তাঁদের আশ্বস্ত করেছে। তবে আলোক মণ্ডল ও নৃপেন মণ্ডল নামে আরও দুই সম্পন্ন ইটভাটার মালিক রয়েছেন ওই এলাকায়। এ বার মাওবাদীরা তাঁদের কাছ থেকেও তোলা আদায়ের চেষ্টা করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন গোয়েন্দারা।
এসআইবি সূত্রের খবর, রাজ্য পুলিশের পাঠানো ১৮ জুনের ওই গোয়েন্দা-রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে— পুরুলিয়া জেলার বলরামপুরে দু’টি মাওবাদী স্কোয়াড গোপনে ঘাঁটি গেড়ে আছে। হলধরের নেতৃত্বাধীন স্কোয়াডের সদস্য সংখ্যা সাত-আট জন। আবার রাঁচি থেকে ন-দশ জন সদস্যের একটি স্কোয়াড বলরামপুরের চন্দনপানি তল্লাটে ঢুকেছে। রাজ্য পুলিশের দাবি, ওই স্কোয়াডে তিন জন মহিলা জঙ্গি রয়েছে। আর নেতৃত্বে ঝাড়খণ্ডের বাসিন্দা প্রভাত মাঝি ওরফে সুখলাল নামে বছর তিরিশের এক যুবক।
বস্তুত, এই পরিস্থিতিতে রাজ্য পুলিশের শীর্ষকর্তাদের একাংশ একটা ব্যর্থতার কথা স্বীকার করে নিচ্ছেন। তাঁদের বক্তব্য, ২০১১-র নভেম্বরে কিষেণজি নিহত হওয়ার পর তেমন সাফল্য বলতে কেবল ২০১২-র মার্চে সুচিত্রা মাহাতোর আত্মসমর্পণ এবং সে বছর জুলাই ও অগস্ট মাসে যথাক্রমে অর্ণব দাম ওরফে বিক্রম এবং রঞ্জন মুণ্ডার গ্রেফতার হওয়া। কিন্তু আকাশ, বিকাশ, রঞ্জিত পাল, জয়ন্ত, মদন মাহাতো, শ্যামল, তারা, জবা-র মতো মাওবাদী নেতা-নেত্রীদের আজ পর্যন্ত ধরা যায়নি। বন্ধ হয়নি লালগড়, বেলপাহাড়ি, বলরামপুর, আড়শা, বাঘমুণ্ডি, জামবনিতে তাদের আনাগোনা। ‘‘আমাদের এই ব্যর্থতার সুযোগে আনাগোনা করা, ক্রমশ সক্রিয় হওয়া এবং তার পর সুযোগ বুঝে এই টাকা চেয়ে চিঠি। ধাপে ধাপে এগোচ্ছে মাওবাদীরা,’’— মনে করেন রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষ অফিসার।
গোয়েন্দাদের আশঙ্কার আরও কারণ, পড়শি ঝাড়খণ্ড বা ওড়িশা থেকে এই রাজ্যে ঢুকে পড়া মাওবাদীরা স্থানীয় কিছু বাসিন্দার ঘরে আশ্রয় পাচ্ছেন। পশ্চিম মেদিনীপুরের নয়াগ্রাম এলাকার ইতিমধ্যেই মাওবাদীদের আশ্রয়দাতা হিসেবে কয়েক জনকে চিহ্নিত করেছে আইবি। কিন্তু প্রশ্ন হল— এলাকার বাসিন্দারা কেন কেউ কেউ এই ঝুঁকি নিচ্ছেন?
গোয়েন্দাদের মতে, কয়েকটি পঞ্চায়েতে পুকুরচুরি, ঠিকাদারদের কাজে দুর্নীতি স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশকে খেপিয়ে তুলেছে।
আর লালগড়ের এক যুবক মুচকি হেসে বলেন, ‘‘মাওবাদীদের আনাগোনা একটু আধটু বাড়লে ক্ষতি কী! বরং তাতে জুনিয়র কনস্টেবল, হোমগার্ড পদে আরও কয়েক হাজার নিয়োগ হবে। আর চাকরি পাবে আমার মতো বেকাররা!’’