শংসাপত্র হাতে কৃতীরা। —নিজস্ব চিত্র
বহু প্রতিভা হারিয়ে যায় অর্থের অভাবে। এমন নজির ভুরি ভুরি দেখেছে খড়্গপুর আইআইটি। গুগল সিইও সুন্দর পিচাই থেকে শুরু করে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিবাল— প্রাক্তনীর তালিকায় বিশ্বজোড়া নাম। অথচ সেই প্রতিষ্ঠানের অনেক পড়ুয়াই আবার শেষ পর্যন্ত স্বপ্ন পূরণ করতে পারেন না। ধার করে পড়ার খরচ চালিয়ে বেশির ভাগ পড়ুয়ার উদ্দেশ্যই হয়ে উঠে চটজলদি একটা চাকরি পাওয়া। যাতে পরিবারে ধার শোধ করা যায়। তাঁদের জন্যই নতুন করে ভাবছে প্রতিষ্ঠান। হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন প্রাক্তনীরা। আইআইটিতে পড়ার খরচ কমিয়ে আনতে ইতিমধ্যেই ‘লার্ন-আর্ন-রিটার্ন’ নামে প্রকল্প তৈরি করেছেন কর্তৃপক্ষ। কী সেই প্রকল্প? দু’দিন ধরে চলা সমাবর্তন অনুষ্ঠান শেষে খড়্গপুর আইআইটি-র অধিকর্তা পার্থপ্রতিম চক্রবর্তী জানান সে কথাই। আইআইটিতে পড়তে আসা একজন পড়ুয়াকে কতটা কম খরচে পড়ানো যায় তা নিয়েই ভাবছেন কর্তৃপক্ষ। প্রায় নিখরচায় পড়ানোই তাঁদের উদ্দেশ্য। সে ক্ষেত্রে প্রাক্তনীদের কাছে আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। সাংবাদিক বৈঠকে পার্থপ্রতিমবাবু বলেন, “প্রত্যেক প্রাক্তনীর কাছে অনুরোধ করেছি প্রতিষ্ঠানের জন্য বছরে অন্তত ১০ হাজার টাকা অনুদান দিতে। প্রায় ৬০ হাজার প্রাক্তনী এই প্রতিষ্ঠানের। অর্ধেক ছাত্রও যদিও আমাদের ডাকে সাড়া দেন তবে বছরে ৩০ কোটি টাকা পাওয়া যাবে। তাতেই বর্তমান পড়ুয়াদের পড়ার খরচ অনেকটা কমানো সম্ভব হবে।’’
আবার এই পড়ুয়ারাও ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠানকে যাতে একই ভাবে সাহায্য করতে পারেন, সে বিষয়টিও প্রকল্পের আওতায় রাখা হচ্ছে। পার্থপ্রতিমবাবু আশাবাদী, “পড়াশোনা প্রায় নিখরচায় করার পরিকল্পনা করেছি আমরা। আবার আজকে যাঁরা প্রাক্তনীদের সাহায্যে পড়াশোনা করবেন, তাঁরা যখন নিজেরা প্রাক্তনী হবেন তখন যাতে তাঁরাও প্রতিষ্ঠানকে সাহায্য ফিরিয়ে দেন সে কথাও বলা হচ্ছে। আমরা আশাবাদী, ইতিমধ্যে সাড়াও পেয়েছি।” এই ‘লার্ন-আর্ন-রিটার্নে’-এর মাধ্যমে পড়ুয়াদের পড়াশোনা কার্যত নিখরচায় করার প্রয়াস এক নজির বলে মনে করছেন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সমস্ত ছাত্র-ছাত্রী কী এই সুবিধা পাবেন? আইআইটি সূত্রে জানা গিয়েছে, বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানে পড়ার খরচ প্রায় ৮ লক্ষ টাকা। তবে প্রতিবন্ধী ছাত্রদের পড়াশোনায় ছাড় দেওয়া হয়। তা ছাড়া পারিবারিক আয় ১ লক্ষ থেকে ৫ লক্ষ টাকা হলে পড়াশোনার খরচে দুই-তৃতীয়াংশ ছাড় পান একজন পড়ুয়া। আবার ৫ থেকে ৬ লক্ষ টাকা পারিবারিক আয় এমন পড়ুয়ারও বৃত্তি পান। সে ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের নিয়ম অনুযায়ী ওই পড়ুয়ার মেধা ৬ পয়েন্টের উপরে হতে হয়। তবে মেলে ‘মেরিট-কাম-মিনস’ বৃত্তি। সে ক্ষেত্রেও পড়াশোনার খরচে নির্দিষ্ট ছাড় পাওয়া যায়। কিন্তু অনেকেই এই বৃত্তির আওতায় আসতে পারেন না। অথচ তাঁদের পারিবারিক অবস্থাও খুব ভাল নয়। এমন ছাত্রদের কথা ভেবেই এই ‘লার্ন-আর্ন-রিটার্ন’ প্রকল্প চালু করছে আইআইটি। স্নাতক স্তরের ডিন রাজেন্দ্র সিংহ বলেন, “আপাতত সমস্ত প্রাক্তনীর কাছে আবেদন জানানো হয়েছে। কারা এই সুবিধা পাবেন তার কোনও মানদণ্ড তৈরি হয়নি এখনও। প্রকল্প চালু হয়ে গেলে নিশ্চয়ই একটা মানদণ্ড তৈরি করা হবে।’’ তিনি জানান, এই শিক্ষাবর্ষ থেকেই প্রকল্প চালু করার ইচ্ছে রয়েছে। প্রযুক্তিবিদ্যায় আন্তর্জাতিক মানের এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়তে পড়ুয়াদের মধ্যে প্রতিযোগিতা যথেষ্ট। সে পড়ার খরচ চালানো সহজ নয়। তবে অনেকেই ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নেন। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পড়াশোনা শেষ করে সেই ঋণ পরিশোধ করার চাপ থাকে সমস্ত পড়ুয়ার উপর। ফলে দ্রুত চাকরিতে যোগ দেওয়ার প্রবণতা থাকে অভাবী পরিবারের পড়ুয়াদের মধ্যে। শিক্ষকদের একাংশ মনে করছেন এর ফলে উচ্চশিক্ষার দিকে পা বাড়াচ্ছে না অধিকাংশ পড়ুয়া। ইচ্ছা থাকলেও সাধ্যে কুলোচ্ছে না। পড়ার খরচ কমলে সেই প্রবণতা কাটিয়ে ওঠা যাবে বলেই মনে করছেন খড়্গপুর আইআইটি কর্তৃপক্ষ। এ দিন আইআইটির অধিকর্তা পার্থপ্রতিমবাবুও সে কথাই শোনালেন। শুধু পড়াশোনার খরচ কমানো নয়। বাংলার শিল্প সংরক্ষণেও জোর দিচ্ছে আইআইটি কর্তৃপক্ষ। চালু হচ্ছে ‘ভৌগলিক নির্দশন’ প্রকল্প। সেখানে গ্রামীণ বাংলার শিল্প সংরক্ষণে আইআইটি জোর দিচ্ছে বলেও জানান পার্থপ্রতিমবাবু। দার্জিলিংয়ের চা বা মেদিনীপুরের গয়না-বড়ির মতো শিল্প যাতে সংরক্ষণ করা যায়, সে বিষয়ে উদ্যোগী কর্তৃপক্ষ। এমনকী শিল্পগুলির পেটেন্ট করতে সচেষ্ট তাঁরা।