আমার জন্ম বাগুইআটির দক্ষিণ পাড়ায়। আমার মনে হয় প্রত্যেকটা মানুষের কলকাতাটা চেনা শুরু হয় দুর্গাপুজো থেকে। আমার কাছেও তাই ছিল। ছোটবেলায় প্রথম বাবা-মায়ের সঙ্গে ঠাকুর দেখতে বেড়নো। আর কলকাতার পূজো নিয়ে তো নতুন করে কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রচণ্ড ভীড়ে বাবার কাঁধে চেপে ঠাকুর দেখেছি। ওই প্রথম কলকাতা দেখা। পুজো ছাড়া খুব একটা বেশি বাইরে বেড়নো হত না। এর পর যখন বড় হতে থাকি, কলকাতাকে চিনলাম শপিং এর সুবাদে। এছাড়া পুরনো কলকাতাকে অন্য একটা দিক থেকে চেনা। সেটা আমার গান-বাজনা। আমি খুব বেশি বাইরে ঘুড়ে বেড়ানোর মতো মেয়ে নই। আমি সব সময় ঘরেই থেকেছি। আসলে বাবা মায়ের সঙ্গে থাকলে এতটাই আনন্দ পেতাম আমি, যে কখনওই মনে হত না বাইরে গিয়ে সেই আনন্দ পাওয়ার দরকার আছে। এমনকী আমরা যে পাড়ায় বড় হয়েছি, পাড়াতে সবাই খেলতে বেরোত। আমাদের ছিল যৌথ পরিবার। ভাই-বোনেরাই এত জন ছিলাম, যে আমাদের পাড়ায় খেলতে যাওয়ার প্রয়োজনই হত না।
আমাদের বাংলার যে ঐতিহ্য, আমার বাবা মা-এর জন্যই সেই স্বাদের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছি। আমি আজকের দিনের মেয়ে হয়েও জিনসের থেকে বেশি স্বচ্ছন্দ সালোয়ার, শাড়িতে। রেস্টুরেন্টে খেতে গেলেও বাঙালি রেঁস্তোরাই পছন্দের। এগুলোই টানে বেশি।
দ্বিতীয়ত বলব আমার সঙ্গীতের কথা। যবে থেকে বোঝার মতো বয়স হয়েছে, তবে থেকেই আমার বাড়িতে শুনে আসছি কখনও রবীন্দ্রসঙ্গীত, কখনও নজরুলগীতি, কখনও বা ভক্তিমূলক গান। রাগাশ্রয়ী গান চলতেও শুনেছি। এই ধরনের স্বাদে আমার বেড়ে ওঠা। তখন তো অত বোঝার মতো বয়স ছিল না। খেলতে খেলতে শুনতাম। সব সময় একটা সাউন্ড আমার কানে থাকত। আমার বাবা অসম্ভব গানবাজনা ভালবাসেন। ছোটবেলায় তো খুব কারেন্ট যেত। লোডশেডিং হয়ে যাওয়াটাই ছিল আমার কাছে খুব আনন্দের বিষয়। বাড়ির ছাদে সবাই মিলে চাদর পেতে বসে পড়তাম। বাবা-কাকু-জেঠু-পিসি-ভাই-বোন সবাই মিলে গান করতাম। এটা খুব আনন্দের জায়গা ছিল। এ সবের জন্যই আমার খুব একটা বাইরের জগতের প্রয়োজন পড়েনি। এমনকী যখন কারেন্ট চলে যেত, আমি আর বাবাই অনেক সময় বসে গান করতাম। বাবার একটা ছোট গানের খাতা ছিল। বাবা সেই গানগুলো গাইত, আমি তার সঙ্গে সুর মেলাতাম। এটা ছিল আমার কাছে ফেবারিট পাসটাইম। এবং সেইগুলো আজও স্বপ্নের মতো লাগে। এখন নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি হওয়ায় এসব কোথায় হারিয়ে গেছে! জানি না, আমি ভবিষ্যতে কী করব।
এখন দেখা যায়, একটা পরিবারে যদি তিনজন মানুষ থাকেন, তার মধ্যে বাবা মা ছেলে সবাই ব্যস্ত। সবাই মিলে একসঙ্গে সময় কাটানো, যার স্বাদ আমরা পেয়েছি, এখনকার প্রজন্ম সেটা কতটা পায়, আমার সন্দেহ আছে। এর জন্য মনে হয় আজকের স্যোসাল মিডিয়াই দায়ি। তাদের সময় কাটানোর সঙ্গী হয়ে উঠেছে টুইটার, হোয়াটস্অ্যাপ ...
আরও পড়ুন, এই শহর এখন বড় অচেনা লাগে
আমি ছোটবেলায় পড়েছি দমদম পার্কের আদর্শ বিদ্যাবিথিতে। তার পর অন্নদাসুন্দরী বালিকা বিদ্যালয়। তার পর কৃষ্ণপুর আদর্শ বিদ্যামন্দির থেকে উচ্চমাধ্যমিক দিয়েছি। আমার শিক্ষাটাই বাংলা মিডিয়ামে। বললাম না, আমাকে এই স্বাদটার সঙ্গে পরিচয় করানোর জন্য বাবা-মায়ের এটা প্রথম পদক্ষেপ। আমার সন্তানকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশোনা করাব, আমার বাবা-মায়ের মধ্যে এটা কোনও দিনও আমি দেখিনি। আমি তার জন্য নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে করি।
আমার গান-বাজনার হাতেখড়ি আমার মায়ের কাছে। গান শিখতে শিখতেই মায়ের বিয়ে হয়ে যায়। হারমোনিয়াম নিয়ে মা এ বাড়িতে চলে আসে। এটা আমার মায়ের কাছে শোনা, তার পর আমি যখন হই তখনই মা বলে দিয়েছিল আমার হারমোনিয়ামটা এবার কাজে লাগবে। তখন সে ভাবে ঠিক বুঝতাম না। মা হারমোনিয়াম বাজাত। আওয়াজ বেরতো একটা। এটাই ছিল খুব আনন্দের। তার পর সারেগামা শেখা। এর পর খুব ছোটবেলা থেকেই স্নেহাশিস চট্টোপাধ্যায়ের কাছে আমি বেশ কিছু দিন তালিম নিই, ভয়েস ট্রেনিং হয়। ক্লাসিক্যাল এবং ভজন শিখেছি তাঁর কাছে। আমার ঘরে যেহেতু সব সময় গান চলত, খুব ছোট বয়সেরও গানের সিডি আছে আমার। বাবা রেকর্ড করে রেখেছিল। আসলে এই করম কালচারেই বড় হয়েছি। আমি গান শিখেছি শুভ্রকান্তি চট্টোপাধ্যায়ের কাছেও। এরপর রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন করি পুরাতনী বাংলা গান নিয়ে। এই গান শিখেছি তিমিরবরণ ঘোষের কাছে। তার পর গান শিখি আমার গুরুমা সরস্বতী দাসের কাছে।
যখন ক্লাস সেভেন-এইটে পড়ি আস্তে আস্তে পড়ার চাপটা বাড়তে শুরু করেছিল। সে সময় একটু রিল্যাকসেশনেরও তাগিদ অনুভব করতাম। দেখতাম সে সময় গান নিয়ে বসলেই রিফ্রেশ লাগত। তাছাড়া আমার মনেরও একটা ভাল লাগা জন্মেছিল। তখন থেকেই বুঝতে শুরু করলাম গানটা আমার একটা ভাল লাগার বিষয়। যদিও সবার আগে সেটা বুঝেছিলেন আমার বাবা-মা। সেজন্য এ পথেই তাঁরা আমাকে নিয়ে গেছেন। আমার কিন্তু পড়তে বসতে একদম ভাল লাগত না। মা বকাঝকা করে পড়তে বসাত। আর বাপি বলত, তুই যদি আমাকে দু’বেলা রেওয়াজ করো শোনাস, তা হলে আমি মায়ের বকা থেকে তোকে বাঁচাব। এই ছিল শর্ত। এসব ছোট ছোট ভাললাগা গুলো থেকেই হয়তো আজকে এই জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছি।
আমার সবচেয়ে ভাল লাগে এটা ভেবে, মানুষ আমাকে শিল্পী বা সেলিব্রিটি হিসাবে ভালবাসে না। আমি তাদের থেকে ভালবাসাটা পাই ঘরের মেয়ে হিসেবে। তাঁরা যখন আমাকে মঞ্চ থেকে নামার পরে বা মঞ্চে থাকাকালীন যে ভাবে আশীর্বাদ দেয়, ভালবাসে সেটা আলাদা অনুভূতি। মনে হয় যেন আমার ঘরেরই লোকরা আমাকে আর্শীর্বাদ করছে।
আমার সারেগামাপা-তে (২০১৫) সুযোগ পাওয়াটাও একটা প্রাপ্তি। আমি আসলে বেশ কিছুদিন আগে আটুটিটু বলে একটা অনুষ্ঠান করি আকাশবাংলায়। ওখানে আমার পরিচয় হয় তন্ময় (বসু) স্যারের সঙ্গে। উনি খুব ভাল একজন মানুষ। এর বহু দিন পরে তিনি ফেসবুকে একটা পোস্ট আপলোড করেছিলেন ‘সারেগামাপা’-র অডিশনের। তখন আমি ফেসবুকেই স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ করি। আমাকে অডিশন দেওয়ার জন্য খুব উৎসাহ দিলেন। এর পর অডিশনে গিয়ে আমি হতবাক। কি গান গাইব ভেবে পাচ্ছিনা! কারণ এখনকার দিনের হিন্দি গানও আমি পারিনা। বাংলা গানও পারিনা। পুরনো দিনের ভাল লাগার গান থেকেই একটা শুনিয়েছিলাম ‘তোমায় কেন এত লাগছে চেনা।’ শোনার পর বিচারকেরা বললেন, হিন্দি গান জান? ‘লাগজা গলে’ গেয়েছিলাম। গানটা শুনে সবার ভাল লাগে। আমাকে এডুকেশ নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। বললাম কীর্তন নিয়ে মাস্টার ডিগ্রি করেছি। শুনে সবাই অবাক। তখন আবার কীর্তন শোনাতে হল। তার পর একটা ফোক শুনলেন। তার পর বললেন, এসো। সৌভাগ্যবশত পরবর্তী অডিশনে ডাক পাই। ওই কীর্তনটাই গেয়ে শোনাতে বলা হল। সেই অডিশনে কালীকাদাও ছিলেন। এর পর একদিন ফাইনাল কল এল, ‘তুমি সিলেকটেড।’ তখন স্বাভাবিকভাবেই আমার খুব আনন্দ হল। এর পর থেকেই টেনশনটা হতে শুরু করল। সিলেকশনের পরে আমাদের গ্রুপ ডিভিশন হয়েছিল। ২০১৫-তে একটা লাইট মিউজিক জঁনার ছিল। ক্লাসিক্যাল জঁনার ছিল আর ফোক জঁনার ছিল। আমাকে ফোক জনারে রাখা হয়েছিল। এর পর আমাকে বলা হয় অদিতি তুমি ফোক জঁনারে কীর্তনকে রিপ্রেজেন্ট করবে। আমি তো অবাক! একটা কর্মাশিয়াল চ্যানেলে কীর্তন... রুমে এসে মাকে ফোন করলাম। বললাম লাগেজ আর খুলছি না। এপিসোড শুরু হতেই আমি এলিমিনেট হয়ে যাব। কারণ কীর্তনতো কেউ শুনবে না। আসলে কেন হয়েছিল এই ধারনাটা বলি। তবে কীর্তন আমার খুব একটা ভাল লাগার জায়গা। যখন এটা নিয়ে আমি পড়তে শুরু করলাম, মানুষজন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে জিজ্ঞেস করত কি পড়ছ? বলতাম মাস্টার্স করছি কীর্তন নিয়ে। লোকজন বিস্ময় প্রকাশ করত। আমার খুব খারাপ লাগত। এমন সুন্দর একটা সাবজেক্টকে মানুষ কেন এত অবহেলা করে কথা বলে! অবশ্য তার দোষ কিছুটা আমাদেরই। আমরা ওটাকে ভাঙতে ভাঙতে এমন জায়গায় নিয়ে এসেছি, যে মানুষের কান পর্যন্ত ঠিকমতো সেটা আর পৌঁছতো না। তো সেই জায়গা থেকে ভাবলাম শো-তে বলিউড, ক্লাসিক্যাল সহ এত ভাল ভাল গান হবে, সে কারণে আমার কীর্তন কেউ শুনবে না।
আরও পড়ুন, বান্ধবীদের কথা যদি বলতেই হয়…
এর পর সারেগামাপা’র প্রথম রাউন্ডের জন্য তৈরি হচ্ছি। মানুষের এত ভালবাসা আর ঠাকুরের আর্শীবাদে কি করে জানি না, আমার গান ভাল লেগে গেল সবার! আর এর পরে সবটাই তো মানুষের জানা।
সারেগামাপার মঞ্চটা আমাকে কাজে আরও উৎসাহ দিয়েছে, মানুষকে ভাল গান শোনানোর। আমি অনেক কিছু পেয়েছি এই মঞ্চ থেকে। মানুষের সংস্পর্শ পেয়েছি, শিক্ষা পেয়েছি। যতটুকু সময় পেয়েছি তার থেকে আদর্শ নিতে পেরেছি। এটা যেন আমার মধ্যে সারা জীবন বজায় থাকে, সেটা চেষ্টা করব। দ্বিতীয়ত, কী ভাবে একজন শিল্পী হতে হবে, একজন মানুষ হতে হবে এই শিক্ষাটা ছিল অনেক বড়। এবং সব কিছুর মাঝেও নিজেকে ধরে রাখা, সামলে রাখা এটা অনেক বড় শিক্ষা। এই স্কুলিংটা ছাড়া আমি আজকের অদিতি হতে পারতাম না। আর জীবনে এই প্ল্যাটফর্মটা না এলে এত মানুষও আমাকে চিনতো না। এত ভালবাসাও পেতাম না সবার থেকে। এ সব তো কলকাতাই আমাকে দিয়েছে।
আমাদের গ্রুপ থেকে প্রথম হয়েছিল সৌম্য আর তুলিকাদি। তবে আমি কোনও পজিশন পাইনি বলে সত্যি আমার মনে কোনও দুঃখ নেই। আজও যখন আমি কোথাও অনুষ্ঠান করতে যাই, সবাই বলে, তোমার পজিশন পাওয়া দরকার ছিল। কিন্তু তার আর দরকার নেই। এত মানুষের ভালবাসা পেয়েছি এটাই তো বিরাট প্রাপ্তি।
আরও পড়ুন, ‘দাদা’ হলেই সব অনিয়ম মাফ
আমার সব স্বপ্নটাই বরাবরই গান-বাজনা নিয়েই ছিল। আমি তো বাংলার নিজস্ব সঙ্গীতটাকে নিয়ে এগোচ্ছি। এটা অনেক সমৃদ্ধ। তাই আমার একার পক্ষে এটাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। বাংলায় আরও অনেক কীর্তন শিল্পীরা আছেন, যারা চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এটা কালীকাদারও (কালীকাপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়) অনেক বড় স্বপ্ন ছিল, কীর্তন আবার মেনস্ট্রিম মিউজিকে ফিরে আসুক। মানুষ এখন যেমন শুনছে, পরবর্তীতেও যেন এভাবেই কীর্তন শোনে।
আমাদের কাছে কলকাতা হচ্ছে ‘তিলোত্তমা কলকাতা’। সেই পুরনো দিন। ঘোড়ায় টানা গাড়ি। ভিক্টোরিয়া, হাওড়াব্রিজ এ সবই মনে পড়ে। এছাড়া জমিদার বাড়ি, সুন্দর গান-বাজনা এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশ। আমাদের ঐতিহ্য যেগুলো। তবে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির চাপে আমাদের এই কলকাতা একটু অন্য মোড়ক নিতে চলেছে। আসলে আমি একটু বাংলা-ঘেষা তো, এই জন্য আমার এ রকম অনুভূতি। আমার মনে হয় পুরনো কলকাতাটা ফিরে এলে আরও বেশি ভাল লাগবে। আর এ শহরের ঐতিহ্যগুলোকে ধরে রাখার দায়িত্ব কিন্তু আমাদেরই। অন্য কারও নয়।
অনুলিখন: পিয়ালী দাস