Health

‘মেয়ে কোলে উঠতে চাইলেও মিথ্যে বলে ফিরিয়ে দিই’

কোভিড-যুদ্ধের একেবারে সামনের সারির সেনানী ওঁরা। ওঁদের কলমে, ওঁদেরই গল্প।কোভিড-যুদ্ধের একেবারে সামনের সারির সেনানী ওঁরা। ওঁদের কলমে, ওঁদেরই গল্প।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ অগস্ট ২০২০ ০৫:০৭
Share:

লাকি মণ্ডল(মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট, সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজ)

কাজের সূত্রে খুব কাছ থেকে মৃত্যুকে দেখেছি। প্রিয়জনকে হারানোর কষ্টও নতুন নয়। কিন্তু পরপর মৃত্যুতে ভেসে যাওয়া গোটা পরিবার, চাইলেও প্রিয় মানুষকে শেষ বার দেখতে না পারার যন্ত্রণা― এমন ঘটনার সাক্ষী এই প্রথম। সেই সাক্ষী থাকার কষ্ট রোজ বহন করাই এক মানসিক নির্যাতন।

Advertisement

বনগাঁর নূতন গ্রামে আমার বাড়ি। মা-বাবার স্নেহ, স্ত্রীর সাহচর্য আর সন্তান সুখে দিনগুলো যেন সোনার কাঠিতে ছোঁয়ানো ছিল। হঠাৎ জেগে উঠল দৈত্য। যার দাপটে বদলে যাচ্ছে পৃথিবী। তার সঙ্গে যুদ্ধে কিন্তু সবাই আমরা সৈনিক। আমি মনে করি, সেনাবাহিনীতে যেমন বিভিন্ন ভাগ থাকে, এখানেও তা-ই। আমার মতো সৈন্যেরা অসুস্থদের থেকে লালারস সংগ্রহ করে, রক্ত নেয়।

মহাকাশচারীর মতোই পোশাক পরে চলে সেই পর্ব। দিনে ৮০-৯০ জনের লালারস সংগ্রহ হয়। পিপিই পরে টানা তিন ঘণ্টা ধরে সেই কাজ করতে কালঘাম ছুটে যায়। প্রত্যেক রোগীর ন্যাজ়াল ও থোরাক্স থেকে এই লালা নিতে পাঁচ-ছ’মিনিট লাগে। সেই সময়ে নরম আলাপচারিতায় রোগী আশ্বস্ত হন। এক বার ভাবুন, পরিজনের মুখ দেখার উপায় নেই ওঁদের! তাই আমাদের আঁকড়ে ধরেন ওঁরা।

Advertisement

আরও পড়ুন: দমদমে বাড়ির কাছ থেকেই মিলল যুবকের রক্তাক্ত দেহ

পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষগুলো এতটাই আতঙ্কে থাকেন যে, যে সামান্য আশ্বাস ওঁদের কাছে দৈববাণীর মতো।

একটি ঘটনা বলি। আমার এক পরিচিতের শ্বশুর-শাশুড়ি দু’জনেই কোভিড পজ়িটিভ হন। দু’জনেরই অন্য শারীরিক সমস্যা থাকায় হাসপাতালে ভর্তি করাতে বলেন ডাক্তার। হাসপাতালের সিঁড়ি দিয়ে হেঁটেই উঠছিলেন স্বামী-স্ত্রী। তখন উপর থেকে নামানো হচ্ছিল পিপিই মোড়ানো এক কোভিড রোগীর দেহ। সেই দৃশ্য দেখে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন দম্পতি। কোনও ভাবেই থাকতে চাইলেন না। তাঁদের বললাম, ‘এটা অন্য কেস, পুড়ে গিয়ে মৃত্যু। আমাকে বিশ্বাস করুন, সব ঠিক হয়ে যাবে। যাঁরা কোভিড নিয়ে ভর্তি হচ্ছেন, তাঁদের প্রায় সবাই সুস্থ হয়ে ফিরছেন। আপনারা তাড়াতাড়ি এসেছেন, সুস্থ হবেনই।’ জাদুর মতো কাজ করেছিল এই কথায়। তাঁরা সত্যিই, চিকিৎসার পরে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। রক্ত বা লালারস নিতে গেলে যখন কোনও রোগী হাতটা চেপে কান্নায় বুজে আসা গলায় বলেন, ‘বাবা, আমি ভাল হয়ে যাব তো!’ তখন তাঁকে কি বলতে পারি, ‘আশা রাখবেন না!’ তাঁকে হেসে বলি, ‘অবশ্যই।’ কিন্তু সে যে কত বড় মিথ্যে অনেক সময়েই তা প্রমাণ হয়ে যায় দু’-তিন দিনের মধ্যে। জমতে থাকে মৃত্যুপথ যাত্রীকে মিথ্যে বলার গ্লানি। অথচ নিরুপায়।

এক রাতের জন্য মাসে এক বার বাড়ি যাই। সদ্য দু’বছর হয়েছে মেয়ে গুগার। মেয়ে কোলে উঠতে চাইলেও মিথ্যে বলে ফিরিয়ে দিই। বলি, ‘ঘুরে এসে নিচ্ছি মা।’ এক দরজা দিয়ে বেরিয়ে আড়াল করে অন্য দরজা দিয়ে ঢুকি। হাসপাতালে আসার আগে বলি, ‘তোমার জন্য চকলেট আনতে যাচ্ছি মা।’ বিশ্বাস করে হাসিমুখে হাত নাড়ে। আমি আসব, সেটা যাতে ও মানে তাই বারান্দায় বাইকটা রেখে আসি। একতলায় একা থাকি। দূর থেকে খাবার দিয়ে যায় বৌ। কাউকে স্পর্শ করি না। এই লড়াইয়ে পরিবার ছাড়াও পাশে রয়েছে গোটা গ্রাম। যখন থাকি না, আমজাদ, সুমন, বিপ্লবরাই তো বাজার করে দেয়। রোজ বাড়ি গিয়ে সবার খোঁজ নিয়ে যায়। আমাকে কুর্নিশ জানায় গোটা গ্রাম। এটাই পরম প্রাপ্তি।

গত কয়েক মাস হাসপাতালের কোয়ার্টার্সে একা থাকি। ফিরেই গরম জলে স্নান আর কাচার পর্ব চলে। দিনে দু’বার গার্গল করি।

ক্লান্তিতেও ঘুম আসে না। শুনতে থাকি ভজন, পল্লিগীতি। তবে লালনের গানে অদ্ভুত শান্তি পাই। ভোরের আলো ফুটতে দেখি রোজ। নতুন সূর্যকে বলি, এ বার সব শান্ত হোক।

(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।

• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন