শান্তিলতা ঘোষ।
অষ্টআশি বছরের বৃদ্ধা যন্ত্রণায় চিৎকার করছেন। হাত-পা চেপে ধরে রয়েছেন চার-পাঁচ জন। বাড়ির লোক রোগীকে ইঞ্জেকশন দিয়ে অবশ করার অনুরোধ জানাচ্ছেন ক্রমাগত। অন্যথায় পরীক্ষা বন্ধ করতেও বলছেন তাঁরা। কিন্তু চিকিৎসক কিছু না-শুনে কোলোনোস্কোপি করেই চলেছেন!
অভিযোগ, পরীক্ষা শেষ করার এক ঘণ্টার মধ্যে বৃদ্ধার পেট ফুলে অসহ্য ব্যথা শুরু হয়। দেখা যায়, কোলোনোস্কোপি করতে গিয়ে কোলন ফুটো হয়ে গিয়েছে তাঁর। পেটের ভিতরে মল ছড়িয়ে সংক্রমণ হয়ে গিয়েছে। অস্ত্রোপচার করেও শেষরক্ষা হয়নি। দু’দিনেই মারা যান সেই বৃদ্ধা।
জুন মাসের এই ঘটনার পরে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর, স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের অফিস, স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তা দেবাশিস ভট্টাচার্যের অফিস এবং মুচিপাড়া থানায় অভিযোগ দায়ের করেছে তাঁর পরিবার। পুলিশ ইতিমধ্যে কেসটি রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের কাছেও পাঠিয়েছে।
নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ‘প্রোব’-এ কোলোনোস্কোপির পরে বনগাঁর বৃদ্ধা শান্তিলতা ঘোষের মৃত্যুর ঘটনা ভাবাচ্ছে স্বাস্থ্য কর্তাদের। প্রথমত, যন্ত্রণাদায়ক বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সময়ে কেন রোগী চাইলে তাঁকে ‘সিডেটিভ’ বা অবশ করার ওষুধ দেওয়া হবে না? দ্বিতীয়ত, পরীক্ষার জন্য সরকারি হাসপাতালগুলির সঙ্গে যে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলির চুক্তি রয়েছে, সেই কেন্দ্রগুলিতে পর্যাপ্ত পরিকাঠামো রয়েছে কি না এবং নিয়ম মেনে সব পরীক্ষা হচ্ছে কি না, তাতে কি আদৌ নজরদারি হচ্ছে?
শান্তিলতা ঘোষের নাতনি ঝিনুক বিশ্বাস বলেন, ‘‘নীলরতনেরই গ্যাসট্রোএন্টেরোলজিস্ট মানস মণ্ডল ‘প্রোব’-এ কোলোনোস্কোপি করেন। বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও দিদাকে অবশ করার ওষুধ দেননি। এমনকী দিদা যখন যন্ত্রণায় চিৎকার করছেন, তখন পরীক্ষা বন্ধের অনুরোধ কানে তোলেননি তিনি।’’ মানসবাবুর উত্তর, ‘‘কোলোনোস্কোপির সময়ে রোগীকে অজ্ঞান বা অবশ করা হয় না। এমন কিছু যন্ত্রণা হয় না। কেউ কেউ একটু বেশি চেঁচান।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘অবশ করতে অ্যানাস্থেটিস্ট লাগবে। চার্জ অনেক বেড়ে যাবে।’’
অনুরোধ সত্ত্বেও থামলেন না কেন মানসবাবু? তাঁর জবাব, ‘‘ওই প্রক্রিয়া এক বার শুরু করলে থামা যায় না। তা ছাড়া, আমরা ভগবান নই। কাজ করতে গেলে মাঝেমধ্যে এমন হতে পারে। ওঁকে বাঁচানোর সব রকম চেষ্টা হয়েছিল।’’ ‘প্রোব’-এর মার্কেটিং ম্যানেজার অমিতাভ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমাদের কোনও সেন্টারেই কোলোনোস্কোপির সময়ে রোগীকে অবশ বা অজ্ঞান করা হয় না। যথেষ্ট দক্ষ চিকিৎসকেরা এটা করেন। হঠাৎ এক-আধটা কেসে দুর্ঘটনাবশত কোলনে ফুটো হওয়ার ঝুঁকি থাকে।’’
গ্যাসট্রোএন্টেরোলজিস্ট অভিজিৎ চৌধুরী কিন্তু বলছেন, ‘‘ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতা সকলের সমান নয়। রোগীর বয়সটাও দেখতে হবে। রোগী চাইলে অবশ্যই ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে ‘কনশাস সিডেশন’ দিতে হবে। এতে রোগী ঘুমিয়ে থাকবেন বা ঘোরে থাকবেন। ব্যথার অনুভূতি কম হবে।’’ গ্যাসট্রোএন্টেরোলজিস্ট জয়ন্ত দাশগুপ্ত, সুজিত কর পুরকায়স্থদের বক্তব্য, কোলোনোস্কোপির সময়ে ‘কনশাস সিডেশন’ দেওয়াই স্ট্যান্ডার্ড প্রোটোকল। কিন্তু বহু জায়গায় নিয়ম মানা হয় না। কারণ, সিডেশন দিতে হলে আলাদা পরিকাঠামো দরকার। তাতে সেন্টারগুলির লাভের পথে বাধা তৈরি হয়।