মনের জোরেই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন জীবন

প্রায় তিন মাস কেটেছে হাসপাতালে। দুই তরুণীকে ট্রেনের ধাক্কা থেকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেরই জীবন-সংশয় হয়ে গিয়েছিল জীবনবাবুর। একটি পা, একটি হাত এবং একটি চোখ আর আগের অবস্থায় ফিরে পাবেন কি না, জানেন না তিনি। আত্মীয়েরা বলছেন, শুধু মনের জোরেই লড়ে চলেছেন জীবন।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০১৯ ০০:৩৯
Share:

লড়াকু: বাড়িতে জীবন সরকার। বুধবার, নৈহাটিতে। নিজস্ব চিত্র

বসতে কষ্ট হয় এখনও। শারীরিক কষ্ট ভুলে তবু জোর করেই উঠে বসেন জীবন সরকার। নিজের ইচ্ছেমতো হাত-পা সাড়া দেয় না তেমন। তবু অদম্য ইচ্ছে নিয়ে আগের মতোই উঠে দাঁড়াতে চান নৈহাটির জীবনবাবু।

Advertisement

প্রায় তিন মাস কেটেছে হাসপাতালে। দুই তরুণীকে ট্রেনের ধাক্কা থেকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেরই জীবন-সংশয় হয়ে গিয়েছিল জীবনবাবুর। একটি পা, একটি হাত এবং একটি চোখ আর আগের অবস্থায় ফিরে পাবেন কি না, জানেন না তিনি। আত্মীয়েরা বলছেন, শুধু মনের জোরেই লড়ে চলেছেন জীবন।

তিনি যেমন একলা লড়েছেন হাসপাতালের শয্যায়, ওঁর হয়ে লড়েছে তামাম পাড়া, বহু অপরিচিত মানুষ— যাঁদের চেনেনই না জীবনবাবু। সে লড়াই অর্থের। বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা-খরচ জোগানোর মতো সামর্থ্য না ছিল জীবনবাবুর, না তাঁর আত্মীয়দের। কিন্তু তাঁর অসময়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন জীবনবাবুর পাড়ার লোকেরা। সংবাদপত্রে তাঁর খবর দেখে অর্থ সাহায্য করেছেন বহু মানুষ। সাহায্য করেছে বাইপাস সংলগ্ন বেসরকারি ওই হাসপাতালও। বিলের ১০ লক্ষ টাকা মকুব করেছে তারা।

Advertisement

আরও পড়ুন: স্বচ্ছ থাকুন, প্রার্থীদের নির্দেশ দিলেন মমতা

বছর দশেক আগে স্ত্রীর সঙ্গে আইনি বিচ্ছেদ হয়ে যায় নৈহাটির ৬ নম্বর বিজয়নগরের বাসিন্দা জীবনবাবুর। বাড়িতে একাই থাকতেন তিনি। একটি ফাস্টফুডের দোকান চালিয়ে সংসার চলত তাঁর। গত ১৩ ডিসেম্বর দুপুরে শ্যামনগরে দিদির বাড়িতে গিয়েছিলেন জীবন। বিকেলে বাড়ি ফেরার জন্য শ্যামনগর স্টেশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সেই সময়ে কানে হেডফোন লাগিয়ে রেললাইন পেরোচ্ছিলেন দুই তরুণী। আপলাইন দিয়ে ধনধান্য এক্সপ্রেস তখন ওই স্টেশনে ঢুকছিল। ট্রেনটি ওই স্টেশনে থামে না। ফলে গতি ছিল বেশ জোর। ইয়ারফোন গোঁজা থাকায় অনেকে চিৎকার করলেও শুনতে পাননি তাঁরা। ট্রেন যখন প্রায় ঘাড়ের উপরে এসে পড়েছে, তখন লাইনে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁদের ঠেলে সরিয়ে দেন জীবনবাবু। তবে নিজে আর সরতে পারেননি। ট্রেনের ধাক্কায় ছিটকে পড়ে জ্ঞান হারান।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও সেখানে তেমন চিকিৎসা না পেলে তাঁকে বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করেন পরিজনেরা। সেখানে তাঁর হাত-পা এবং মাথায় একাধিক অস্ত্রোপচার হয়েছে। ডান হাত, ডান পা নড়াতে পারেন না ভাল ভাবে। ডান চোখের দৃষ্টি এখনও ঝাপসা। তবুও চিকিৎসায় অনেকটাই উন্নতি হয়েছে। আগে লোকজন দেখলে চিনতে পারতেন না। এখন পারেন। কথা বলতে পারতেন না। এখন বলেন।

আরও পড়ুন: মিমিরা ভোটে! বিকৃতির উল্লাস নেট-দুনিয়ায়

হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরতে পেরে খুশি জীবনবাবু। সে দিন কী ঘটেছিল বলতে গিয়ে বারবার উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন তিনি। জীবনবাবু বলছেন, ‘‘ওই মেয়ে দু’টো তো মরেই যেত। দেখে আর ঠিক থাকতে পারিনি। ওদের বাঁচাতে গিয়ে আমার লাইফটাই তো...।’’ কথা শেষ করতে পারেন না। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। পরিজনেদের ক্ষোভ, যাঁদের বাঁচাতে গিয়ে জীবনের এই হাল হল, তাঁরা একটি বারের জন্যও সামনে আসতে পারলেন না! মানবিকতা বলেও কি কিছু নেই ওঁদের?

হাসপাতালে বিল হয়েছিল ৩৯ লক্ষ টাকা। পরিবারের লোকেরা ৮-৯ লক্ষ টাকা জোগাড় করেছিলেন। ওই এলাকার কাউন্সিলর সনৎ দে জানান, কুপন ছাপিয়ে কিছু টাকা জোগাড় করা হয়েছিল। শুধুমাত্র চিকিৎসার জন্য একটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট করা হয়েছিল।

সংবাদপত্রে খবর দেখে বিভিন্ন লোক সেই অ্যাকাউন্টে টাকা দিয়েছেন। সব মিলিয়ে অ্যাকাউন্টে ১৮ লক্ষ ৬৩ হাজার টাকা জমা পড়ে। কয়েক জন সরাসরি ওই হাসপাতালে কিছু টাকা জমা করেন। তার পরেও ১০ লক্ষ টাকা জোগাড় হয়নি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সেই টাকা নেননি। তাঁরা জানিয়েছেন, জীবনবাবুর সাহসিকতাকে সম্মান জানিয়ে তাঁরা ওই টাকা মকুব করেছেন।

চিকিৎসা এখনও বাকি। জীবনবাবু জানালেন, তিনি হাল ছাড়বেন না, লড়বেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন