উদ্যোগ: ‘স্নেহনীড়ে’ ক্যানসার আক্রান্ত শিশুরা। —নিজস্ব চিত্র।
বছর তিনেকের ছেলেটার কেমোথেরাপি শুরু হয়েছে। রক্তের ক্যানসার। দূর জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে দিনমজুর বাবা-মা ধারদেনা করে তাকে নিয়ে এসেছেন কলকাতার নামী সরকারি হাসপাতালে। এই প্রথম গ্রামের বাইরে বেরোলেন তাঁরা। অচেনা শহর, অপরিচিত লোকজন। হাতে নামমাত্র টাকাপয়সা।
টানা কয়েক সপ্তাহ কেমো চলবে। চিকিৎসা ‘ফ্রি’ হলেও ওই ক’টা দিন কলকাতায় ঘরভাড়া নিয়ে থাকবেন, এমন আর্থিক ক্ষমতা নেই দরিদ্র অভিভাবকের। ফলে অসুস্থ শিশুকে নিয়ে তাঁরা আশ্রয় নেন হাসপাতাল চত্বরের এক কোণে। সেখানে শয়ে-শয়ে লোকের আনাগোনা। সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা প্রবল, রোগীর পক্ষে একটু নিরিবিলি বিশ্রামও অসম্ভব।
রোগী এই ভাবে থাকলে চিকিৎসার কাঙ্খিত ফল কিছুতেই হবে না বুঝতে পারছিলেন কলকাতার সরকারি হাসপাতালের ক্যানসার বিশেষজ্ঞদের একাংশ। সে কথা জানিয়েছিলেন স্বাস্থ্য দফতরে। তার পরেই বাড়ি থেকে কলকাতায় চিকিৎসা করাতে আসা ক্যানসার আক্রান্ত দরিদ্র শিশু ও তাদের অভিভাবকদের কিছু দিনের জন্য ঠাঁই দিতে চালু হয়েছে প্রকল্প। একে বলা হচ্ছে ‘হোম অ্যাওয়ে ফ্রম হোম’, অর্থাৎ, বাড়ির বাইরে আর একটি বাড়ি।
একটি সর্বভারতীয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে এ ব্যাপারে চুক্তি সই হয়েছে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের। নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও এসএসকেএম হাসপাতালের দরিদ্র শিশু ক্যানসার রোগী ও তাদের অভিভাবকদের থাকার জন্য আনন্দপুর এলাকায় হোম চালু করেছে ওই সংস্থা। নাম ‘স্নেহনীড়’। কেমো চলছে এমন ২১ জন রোগী ও দু’জন করে অভিভাবক একসঙ্গে কিছু দিন থাকার পরিকাঠামো আছে সেখানে। পুরোটাই নিখরচায়। প্রতিদিন একটি গাড়ি ওই শিশুদের সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে নিয়ে আসে। বিকেলে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
এনআরএসের হেমাটোলজি বিভাগের প্রধান প্রান্তর চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘কেমো চলাকালীন রোগীদের যতটা সম্ভব জীবাণু মুক্ত থাকা, সুষম খাবার, বিশ্রাম দরকার। কিন্তু আমরা দেখছিলাম, গরিব মানুষেরা অসুস্থ শিশুকে নিয়ে হাসপাতাল চত্বরেই দিন কাটাচ্ছেন।’’ তিনি জানান, কেমোর পরে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। অনেকের রোগ বারবার ফিরে আসছিল। তখনই এই পরিকল্পনা হয়।
ওই হোমে গিয়ে দেখা গেল, তিনটি তলার প্রতিটি ঘরে বাঙ্ক-খাট, আলমারি, এয়ার কুলার, জলের ফিল্টার। অনেকটা বড় যৌথ পরিবারের মতো থাকছেন সকলে। উত্তর দিনাজপুরের আট বছরের লায়েক হাসান, পশ্চিম মেদিনীপুরের চার বছরের করিশ্মা প্রতিহার, বাঁকুড়ার ন’বছরের অভিজিৎ শর্মা, মালদহের বছর দশেকের আকাশ কর্মকার— একসঙ্গে ভাত খাচ্ছিল। অভিভাবকেরা হোমেই রান্নাবান্না করেন। তাঁদের চাল-ডাল-তেল সবই নিখরচায় দেওয়া হয়। শুধু আনাজ, মাছ-মাংস-ডিম কিনতে হয়। সন্ধ্যায় শিক্ষক আসেন শিশুদের পড়াতে। স্নেহনীড়ে সকলেই সমব্যথী। চিকিৎসকদের মতে, এতে শিশু ও অভিভাবকদের অবসাদ ও মানসিক চাপও অনেকটা নিয়ন্ত্রিত হয়।
স্বাস্থ্যকর্তারা জানালেন, আনন্দপুর অঞ্চলে হোমটি চালু করার সময়ে স্থানীয়দের একাংশ প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। অনেকেই বলেছিলেন, এত রোগী থাকলে পাড়ায় রোগ ছড়াবে। তিনটি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসকেরা গিয়ে স্থানীয়দের বোঝান, আশঙ্কা অমূলক। স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘রোগী ও তার পরিবার যদি পয়সার অভাবে থাকতেই না পারেন, তা হলে আর হাসপাতালে ফ্রি চিকিৎসা দিয়ে লাভ কী! এই কথা ভেবেই হোম চালু হয়। রোগীর সংখ্যা এবং চাহিদা খুব বেশি। তাই আরও কয়েকটি হোম খোলা হবে।’’