মিছিলে হাঁটছেন মমতা-অভিষেকরা। ছবি: সংগৃহীত।
ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) প্রক্রিয়া নিয়ে ‘আতঙ্কের’ প্রতিবাদে মঙ্গলবার কলকাতায় মিছিল করল তৃণমূল। আর সেই মিছিল শেষে ‘অভয়বার্তা’ দিতে চাইলেন তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেত্রী তথা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নিজেকে ‘দিদি’ হিসাবেই তুলে ধরে মমতা বলেন, ‘‘দিদি এখনও আছে! ভয় পাবেন না। ওরা কারও নাম বাদ দিতে পারবে না।’’ মমতা আরও বলেন, ‘‘দরকারে থালাবাটি বেচে আমরা আপনাদের সাহায্য করব। যাঁদের কোনও কাগজ নেই, তাঁরা তৃণমূলের ক্যাম্পে যান। আমাদের কর্মীরা সমন্বয় করে সব তৈরি করার বন্দোবস্ত করবে।’’
মমতার আগেই বক্তৃতা করতে উঠে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দিলেন, নেত্রীর অনুমতি নিয়েই তিনি বলছেন, আগামী দু’মাসের মধ্যে এসআইআর নিয়ে দিল্লি অভিযানে যাবে তৃণণূল। কয়েক দিন ধরেই দিল্লি অভিযানের প্রস্তুতির বিষয়ে সংগঠনে বার্তা দিচ্ছিলেন অভিষেক। মঙ্গলবার কার্যত বলেই দিলেন, দু’মাসের মধ্যেই হবে সেই অভিযান। সূত্রের খবর, এসআইআর প্রক্রিয়া ঠিক কেমন ভাবে চলছে, তা মেপে নিতে চাইছেন অভিষেক। তেমন হলে সপ্তাহখানেক পর থেকেই তিনি জেলা সফরে যেতে পারেন। যদিও গোটাটাই পরিকল্পনার স্তরে রয়েছে। এখনও কিছুই চূড়ান্ত নয়। মঙ্গলবার ‘এসআইআর আতঙ্কে মৃত’দের ‘শহিদ’ বলে অভিহিত করেন অভিষেক। মঞ্চের সামনে গত সাত দিনে মৃত সাত জনের নাম সংবলিত তোরণও ছিল। তাতে পুষ্পার্ঘ্য দিয়ে তার পর মঞ্চে ওঠেন মমতা এবং অভিষেক।
তৃণমূলের মিছিল তখন রেড রোডে। ছবি: সংগৃহীত।
মঙ্গলবার দুপুরে রেড রোডে বিআর অম্বডকরের মূর্তির সামনে থেকে মিছিল শুরু করেন মমতা এবং অভিষেক। সে মিছিলে ভিড়ও হয়েছিল চোখে পড়ার মতো। বিভিন্ন ধর্মের গুরু থেকে শুরু করে টেলি-টলি তারকা, খেলোয়াড়েরাও পা মিলিয়েছেন মিছিলে। প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার পথ পেরিয়ে মিছিল শেষ হয় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সামনে। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের উপর জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির যে তোরণ রয়েছে, তার পাশেই বাঁধা হয়েছিল মঞ্চ। তৃণমূলের মিছিল এবং সভা ঘিরে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা অবরুদ্ধ ছিল সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ।
মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন মতুয়া সম্প্রদায়েরও একদল মানুষ। নিজস্ব বাদ্যযন্ত্র সহযোগে মিছিলে হাঁটেন তাঁরা। সভায় মমতা বলেন, ‘‘মতুয়াদের ভুল বুঝিয়ে দু’নম্বরি করে টাকা তোলা হচ্ছে। বলেছিল নাগরিকত্ব দেবে। কিন্তু দেয়নি। এখন এ সব করছে।’’ অভিষেকও মতুয়াদের সতর্ক করতে চেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘মতুয়া ভাইবোনেদের কাছে অনুরোধ করব, বিজেপির ফাঁদে পা দেবেন না। তা হলে আপনাদের অবস্থাও অসমের ১২ লক্ষ হিন্দু বাঙালির মতো হবে।’’
নির্বাচন কমিশন এসআইআর প্রক্রিয়ায় ২০০২ সালের ভোটার তালিকাকে সূচক ধরেছে। কমিশন বলেছে, ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় যাঁদের নাম ছিল, তাঁদের কোনও নতুন করে কোনও নথি জমা দিতে হবে না। দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুলপি-সহ বিভিন্ন এলাকার ভোটার তালিকা দেখিয়ে তৃণমূল দাবি করেছে, সেখানে ২০০৩ সালের তালিকাকে সূচক করা হচ্ছে। মঙ্গলবার মমতা এবং অভিষেক কমিশনের এদিক-ওদিক নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। মমতার কথায়, ‘‘আপনারা তৈরি থাকুন। বুথ থেকে কোর্ট, কোর্ট থেকে রাস্তা, সর্বত্র লড়াই হবে। মানুষের নাম কেটে ওরা আমাদের হারাতে পারবে না।’’ মঙ্গলবারের কর্মসূচি থেকেও মমতা এবং অভিষেক দু’জনেই বিজেপি এবং কমিশনকে একই বন্ধনীতে ফেলে আক্রমণ শানিয়েছেন। নাম না-করে মমতা আক্রমণ শানান নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ, শুভেন্দু অধিকারী এবং দেশের নির্বাচন কমিশনারকে।
কয়েক বছর আগে তৃণমূলের বিরুদ্ধে সল্টলেক পুরসভা নির্বাচনের সময়ে অভিযোগ উঠেছিল, প্রয়াত হওয়ার পরেও সঙ্গীত শিল্পী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের নামে ভুয়ো ভোট দিয়ে দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার প্রয়াত দ্বিজেনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে মমতা বলেন, ‘‘১৯৮৯ সালে দ্বিজেনদা শ্যামপুকুর থেকে সল্টলেকে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু ২০০২ সালের তালিকায় তাঁর নাম ছিল না।’’ ২০০২ সালের তালিকা কতটা নির্ভুল, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন মুখ্যমন্ত্রী। পাশাপাশি অভিষেকের তুলে ধরা ভাষ্য ফের মমতার মুখে শোনা গিয়েছে মঙ্গলবার। তৃণমূলনেত্রী বলেন, ‘‘বাংলাদেশ এবং মায়ানমারের সীমানা রয়েছে যে রাজ্যগুলির সঙ্গে, সেই ন’টি রাজ্যের মধ্যে একমাত্র কেন বাংলাতেই এসআইআর হচ্ছে? কেন অসমে হচ্ছে না। ওখানেও তো ভোট। কারণ, অসমে হলে বিজেপি হেরে যাবে।’’ বিজেপির উদ্দেশে হুঁশিয়ারির সুরে মমতা আরও বলেন, ‘‘ভোটার তালিকা থেকে এক জন বৈধ ভোটারের নাম বাদ দিলে দিল্লির সরকারও ভেঙে দেব।’’
মুখ দেখানোয় নিষেধ
মঙ্গলবার মিছিল শুরুর আগে মাইক হাতে নিয়ে দলের নেতাদের উদ্দেশে শৃঙ্খলার বার্তা দিয়েছেন মমতা। শুরুতেই তিনি বলেন, ‘‘যে যত বড় নেতামন্ত্রীই হোন না কেন, ধাক্কা মেরে সামনে আসবেন না। কর্মীদের সঙ্গে হাঁটুন। মুখ দেখাবেন না।’’
রাস্তা জুড়ে ইন্দ্রনীল
মঙ্গলবার মিছিল উপলক্ষে সোমবার একটি গান প্রকাশ করেছিল তৃণমূল। মমতার লেখা এবং সুর করা সেই গান গেয়েছেন রাজ্যের মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন। মঙ্গলবার দিনভর রেড রোড থেকে জোড়াসাঁকো পর্যন্ত কয়েকশো চোঙায় টানা বেজে গেল ইন্দ্রনীলের গাওয়া সেই গান।
গান বানাবেন বাবুল!
মঞ্চে বক্তৃতা করতে করতে মমতা বলেন, বিজেপি-কে এ বার ধাক্কা দিতে হবে। কী ভাবে ধাক্কা? স্বগতোক্তির মতো করে মমতা বলেন, ‘‘একটা গান লিখে দেব। ধাক্কা, ধাক্কা, ধাক্কা!’’ বলেই মঞ্চের বাঁ দিকে বসে থাকা রাজ্যের আরএক গায়ক মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়ের দিকে চোখ যায় মমতার। তিনি বলেন, ‘‘এই যে বাবুল সুপ্রিয়! একটা গান বানাও তো। যাতে ওই ধাক্কাটা থাকে!’’