কমিশন অফিসে মীরা পাণ্ডে। নিজস্ব চিত্র
সেই পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময়ে সরকারের সঙ্গে তাঁর সংঘাতের সূচনা। আর পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষে সংঘাতের বাতাবরণেই রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের কুর্সি ছাড়লেন মীরা পাণ্ডে। সোমবার যখন তিনি যখন শেষ বারের মতো অফিস ছেড়ে গেলেন, ১৭টি পুরসভার ভোট নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে কমিশনের বিরোধ আদালতের মীমাংসার অপেক্ষায়।
এবং বিদায় নেওয়ার আগে মীরাদেবী এ দিন জানিয়ে গিয়েছেন, “আমি লড়াকু মহিলা।”
দীর্ঘ কর্মজীবনকে যেন এই এক কথায় বাঁধতে চেয়েছেন প্রবীণ আইএএস অফিসার। প্রসঙ্গত, নতুন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার হিসেবে আজ, মঙ্গলবার কাজে যোগ দেওয়ার কথা অবসরপ্রাপ্ত ডব্লিউবিসিএস অফিসার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়ের, যা নিয়ে গোড়াতেই বিতর্ক তৈরি হয়েছে। প্রশাসনের একাংশের মতে, গত পঞ্চায়েত ভোটের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে মীরাদেবীর উত্তরসূরি হিসাবে মুখ্যমন্ত্রী এমন এক জনকে চেয়েছেন, যাঁর তত্ত্বাবধানে পুরভোট হলে কমিশনের সঙ্গে সরকারের বিরোধ হবে না। বিশেষত পুরভোট নিয়ে যখন হাইকোর্টে মামলা চলছে।
মীরাদেবী মনে অবশ্য মনে করছেন, তিনি না-থাকলেও কমিশনের উচিত আইনি লড়াইটি চালিয়ে যাওয়া। ১৭টি পুরসভায় সময় মতো ভোট আয়োজনের দাবি জানিয়ে কমিশন হাইকোর্টে মামলাটি করেছে। নতুন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জনবাবু অবশ্য এ প্রসঙ্গে এ দিন মুখ খুলতে চাননি। “মামলাটি হাইকোর্টে বিচারাধীন। কোনও মন্তব্য করব না।” এক প্রশ্নের জবাবে বলেন তিনি।
১৯৭৪ ব্যাচের আইএএস মীরা পাণ্ডে চাকরিজীবনে বহু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সামলেছেন। একেবারে শেষে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের গুরুদায়িত্ব। রাজ্য প্রশাসনের কয়েক জন শীর্ষ কর্তা জানিয়েছেন, মীরাদেবী বরাবরই কঠোর মনোভাবের। স্পষ্টবাদী। এ দিন তাঁর নিজের কথায়, “যখন যে দায়িত্বে ছিলাম, কিছু না কিছু সমস্যা হয়েছে। কারণ, আমি বরাবর আইনের পথে থেকেছি।” এবং আইনের যুক্তিতেই গত পঞ্চায়েত ভোটের আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন তিনি। কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট আয়োজন কিংবা নির্বাচনের দিন ঠিক করার এক্তিয়ারের প্রশ্নে ওই বিরোধের জল গড়ায় সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত। এক-আধ দিন নয়, ক’মাস ধরে টানাপড়েন চলেছে।
অনেকটা যেন তারই ধারাবাহিকতায় ১৭ পুরসভার নির্বাচন নিয়ে নতুন আইনি লড়াই শুরু করে দিয়ে গেলেন মীরা পাণ্ডে। তবে এ সবে ক্লান্ত নন। বরং খুশি। অফিসে শেষ দিনটা তিনি কী ভাবে কাটালেন?
এ দিন বেলা সাড়ে এগারোটায় তাঁর গাড়ি এসে কমিশনের অফিসের সামনে দাঁড়ায়। বিদায়ী কমিশনার টুকিটাকি কাজ সেরে কমিশনের নতুন সচিব ওসমান গনি ও যুগ্ম-সচিব সব্যসাচী ঘোষের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। কয়েক জন দর্শনার্থীর সঙ্গে কথা বলেন। তার পরেই রাশভারী ভাব সরিয়ে রেখে নিখাদ আড্ডায় ডুবে যান সহকর্মী ও সাংবাদিকদের সঙ্গে। বলেন, “রাজ্য নির্বাচন কমিশনের কাজটা যেমন চ্যলেঞ্জিং, তেমনই সম্মানের। সেই কাজ করে আমি আনন্দিত। সব প্রতিষ্ঠানেরই কিছু বাধ্যবাধকতা থাকে, খামতি থাকে। এখানেও আছে।” এ-ও বলেন, “খামতি মেটাতে সরকারের কাছে কিছু সংশোধনের সুপারিশ করেছি। রাজ্য কিছু মেনেছে, কিছু মানেনি। আশা করি, সময়ের সঙ্গে আইনের আরও পরিবর্তন হবে।”
কোন কাজটা করে সব চেয়ে বেশি আনন্দ পেয়েছেন? মীরাদেবীর জবাব, “কলকাতা পুরসভার ২০১০-এর ভোটে যখন প্রথম কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়োগ করা হয়েছিল।” পাশাপাশি প্রকারান্তরে জানিয়েছেন, পাঁচ বছরের মেয়াদকালে পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিরোধের ঘটনাই তিক্ততম অভিজ্ঞতা। “পঞ্চায়েত ভোট থেকে অনেক কিছু শিখেছি। রাজ্যের মানুষকে ধন্যবাদ। কারণ তাঁরা বুঝতে পেরেছেন, আমি কী করতে চেয়েছি। তাঁরা আমার প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেছেন।” মন্তব্য মীরাদেবীর।
সহকর্মীরা এ দিন ওঁর জন্য বিদায় সংবর্ধনার আয়োজন করেছিলেন। সেখানেও ‘আমরা-ওরা’র ছায়া। শাসকদলের সমর্থক কিছু কর্মী অনুষ্ঠানে যোগ দেননি। তাতে অবশ্য আলাপচারিতায় তাল কাটেনি। যাওয়ার সময় এলে মীরাদেবী মজা করে সহকর্মীদের বললেন, ‘‘আমার কফিটা দিলেই উঠে পড়ি।’’ তাঁর ছেড়ে যাওয়া পদে বিসিএস অফিসারকে বসানোর ব্যাপারে অবশ্য কোনও মন্তব্য করেননি।
শেষ দিনেও মীরা পাণ্ডে অফিস ছাড়লেন ঘড়ি ধরে বিকেল সওয়া পাঁচটায়।