পানীয় জল নিতে পড়ুয়াদের লাইন স্কুলের পাশের চাষের জমিতে।
স্কুলের পিছনেই ধানজমি। শ্রেণিকক্ষ খালি করে সেই জমির আলপথে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে খুদে পড়ুয়ারা। দিগন্ত জোড়া সবুজ খেতের সৌন্দর্য্য দেখতে বা অন্য কোনও উদ্দেশে নয়, তেষ্টা মেটাতে!
পাম্প থেকে জল পড়তে শুরু করলেই বোতল হাতে এক ছুটে পড়ুয়ারা জড়ো হয় সেখানে। পেট ভরে জল খেয়ে, বোতলে ভরে তবে ক্লাসে ফেরা। এক দিন, দু’দিন নয় মাস খানেক এটাই রুটিন এগরা ২ ব্লকের বিদুরপুর উচ্চ মাধ্যমিক হাইস্কুলের পড়ুয়াদের।
কেন? প্রধান শিক্ষক অবিনাশ জানা বলতে থাকেন, “কুড়ি-পঁচিশ দিন হল স্কুলের কলটা খারাপ হয়ে রয়েছে। সে কথা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি, বিডিওকে লিখিত ভাবে জানিয়েছি। কিন্তু, কাজ কিছুই হয়নি।” স্কুল সূত্রে খবর, সপ্তাহ খানেক আগে প্রশাসনের লোকেরা এসে বলে, ‘জলস্তর নেমে গিয়েছে। বৃষ্টি শুরু না হলে জল আর উঠবে না!’ অবিনাশবাবুর কথায়, “ছেলেমেয়েরা স্কুলের জানলা দিয়ে পাম্পের জল পড়া দেখলেই ক্লাস ফাঁকা করে চলে যায়। প্রশ্ন যখন খাবার জল নিয়ে তখন ওদের বাধা দিই কী করে!”
শুধু বিদুরপুর নয়, প্রায় এক মাস হল তমলুকের চণ্ডীপুরের শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ প্রাথমিক স্কুলের নলকূপ খারাপ হয়ে গিয়েছে। ওই প্রাথমিক স্কুলের পাশেই রয়েছে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র। নলকূপ খারাপ থাকায় মিড-ডে মিল ও অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের শিশুদের খাবার রান্নার জল আনতে হয় দূর থেকে। কোলাঘাট ব্লকের বৃন্দাবনচক এলাকার জগন্নাথপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নলকূপটিও বেশ কয়েক মাস ধরে খারাপ পড়ে। সেখানেও বিপাকে পড়ুয়া, শিক্ষকেরা। এগরার দাউদপুর নটবর স্কুলেরও এক অবস্থা। প্রধান শিক্ষক কিশোর বোস জানান, তাঁদের স্কুলের কলেও জল পড়ছে না।
পরিস্থিতি এমন যে, ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানোর ব্যাপারে দ্বিধায় অভিভাবকেরা। এগরা ২ ব্লকের বিদুরপুরের পবন ওঝা ও শেখ আসরফ বলছেন, “পরিস্থিতির উন্নতি না হলে ওদের স্কুলে পাঠানো বন্ধ রাখা ছাড়া উপায় থাকবে না।” অষ্টম শ্রেণির রাজা গুঁড়িয়া ও দশম শ্রেণির রাইমিনা খাতুনরা বলছে, “দুপুরের গরমে এখনই গলা শুকিয়ে যায়। স্কুলে খাবার জলটুকুও নেই।” সপ্তম শ্রেণির সাবানা খাতুন বলে, “অনেকেই মিড-ডে মিল খাবার পরে পাশের পুকুরের জলেও তেষ্টা মেটায়। তবে স্যারেরা ওই জল খেতে মানা করেছেন।” এগরা ২ এর বিডিও মৃণ্ময় মণ্ডল অবশ্য আশ্বাস দিয়েছেন, “দ্রুত কাজ শুরু হবে।”
পুকুরই ভরসা ছাত্রছাত্রীদের।
গরম পড়তেই পূর্ব মেদিনীপুরের বহু স্কুলে জলসঙ্কট শুরু হয়েছে। জলস্তর নামছে হু হু করে। তার ফলেই একের পর এক নলকূপ অকেজো হচ্ছে বলে প্রশাসন সূত্রে খবর। এই অবস্থায় জেলার বেশ কিছু প্রাথমিক স্কুল ও অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের কর্তৃপক্ষ গ্রাম পঞ্চায়েত, ব্লক প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছে। কোথাও দূর থেকে জল নিয়ে মিড-ডে মিলের কাজ চালানো হচ্ছে, কোথাও ভরসা স্কুলের কাছাকাছি থাকা স্থানীয় বাসিন্দারা। পুকুরের জল ব্যবহার করছেন, এমন দৃশ্যও রয়েছে।
সমস্যার কথা অজানা নয় জেলা প্রশাসনের। জেলা পরিষদের জনস্বাস্থ্য দফতরের কর্মাধ্যক্ষ পার্থপ্রতিম দাস বলেন, “গরম পড়তেই ব্লকপিছু কমবেশি ১০ থেকে ২০টি নলকূপ অকেজো হওয়ার রিপোর্ট আসছে। সেগুলি দ্রুত মেরামতির জন্য জানুয়ারি মাসেই জেলার প্রতিটি পঞ্চায়েত সমিতিকে এক লক্ষ টাকা করে বরাদ্দ করা হয়েছে।” নন্দকুমার পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সুকুমার বেরাও বলছেন, “চলতি মাসেই ব্লকের ১১টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ৯টি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের নলকূপ মেরামতির আবেদন জমা পড়েছে।”
ব্লকপিছু যখন দশ থেকে কুড়িটি নলকূপ খারাপ হওয়ার রিপোর্ট আসছে, তখন এত কম টাকার সব নলকূপের মেরামতি কী ভাবে সম্ভব? জনস্বাস্থ্য কর্মাধ্যক্ষের জবাব, “জেলা পরিষদ থেকে দেওয়া অর্থ ছাড়াও পঞ্চায়েত সমিতি ও গ্রাম পঞ্চায়েতগুলি নিজস্ব তহবিল খরচ করে মেরামতি করতে পারে।”
জেলা পরিষদ ও স্থানীয় সূত্রে খবর, পূর্ব মেদিনীপুরে বর্তমানে ৩২৬৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১৪৪২টি শিশু শিক্ষাকেন্দ্র ও ৫৯৬৯টি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র রয়েছে। এ ছাড়াও মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্র, মাদ্রাসা মিলিয়ে আরও প্রায় এক হাজারের বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এই সব স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মিড-ডে মিল, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে আসা শিশু-প্রসূতি মায়েদের রান্না করা খাবার দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। এই সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের খাবার রান্না ছাড়াও ছাত্রছাত্রীদের পানীয় জলের মূল ভরসা নলকূপ বা সাব-মারসিবল পাম্প। কিন্তু শীতকাল থেকেই জলস্তর নামতে শুরু করায় গোল বেধেছে।
কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়, দেখার সেটাই।
(সহ প্রতিবেদন: আনন্দ মণ্ডল)
—নিজস্ব চিত্র।