মাংসের গন্ধেই জামাই আদরে আনমনা লালু

পুলিশ তুলে এনে নাকাশিপাড়ার হোমে তাঁকে পৌঁছে দিয়েছিল, তাও বছর চারেক হল। কিন্তু সে তো শুধু খেরোখাতার হিসেব। ছোটখাটো সন-তারিখের অমন লাল কালির দাগ আর মাথায় নেই লালু দাসের।

Advertisement

সামসুদ্দিন বিশ্বাস

নাকাশিপাড়া শেষ আপডেট: ০১ জুন ২০১৭ ১৩:৪২
Share:

পাত: হোমের চত্বরে। নিজস্ব চিত্র

অতীত তাঁর মনের রুলখাতায় খানিক মুছে-মুছে গিয়েছে। বাড়ির ঠিকানাও আর মনে পড়ে না।

Advertisement

পুলিশ তুলে এনে নাকাশিপাড়ার হোমে তাঁকে পৌঁছে দিয়েছিল, তাও বছর চারেক হল। কিন্তু সে তো শুধু খেরোখাতার হিসেব। ছোটখাটো সন-তারিখের অমন লাল কালির দাগ আর মাথায় নেই লালু দাসের।

বরং কাঁচাপাকা মাথা জুড়ে এখন ইলিবিলি খেলা করে মহাকাল। আর মধ্যে-মধ্যে বুদ্বুদের মতো উঠে আসে দু’একটা ঝাপসা জলছবি, যা সত্যি হতে পারে আবার না-ও হতে পারে। সেই জলছবিতে কোন কচি বয়সের এক জামাইষষ্ঠী। মাথায় চিকন কালো চুল। পাশে খুশিতে ডগোমগো বউটি, যার মুখটাও এখন আর মনে পড়ে না।

Advertisement

জামাইষষ্ঠী কোন মরদের হয়?

যার বিয়ে হয়েছে, অন্তত হয়েছিল কোনও কালে। শুধু তা হলেই তো হবে না! লালুর বউ ছিল আলবত। তিন ছেলেও ছিল। মহাকালে আঙুল ডুবিয়ে সে অন্তত এমনই ছবি খুঁজে পেয়েছে। একখানা সংসারের ছবি।

কিন্তু শাশুড়ি? শ্বশুর?

জামাইষষ্ঠী হতে গেলে শ্বশুর তো একটা লাগেই, যাঁর পকেটে মোহর ঝনঝন না করলেও জামাইকে আমটা, জামটা, কচিপাঁঠার ঝোলটা খাওয়াতে পারলে ছাতি ফোলে। আর লাগে এক শাশুড়ি, চাঁদের টানে মাজা টাটালেও বাতে ঘুণ ধরে যায়নি যাঁর পায়ের গোছে, এখনও উবু হয়ে বসে জামাই বাবাজির মাথায় দুব্বোর ছড়া ঠেকিয়ে দিব্যি ‘ষাট ষাট’ করতে পারেন। খুন্তি নেড়ে ভেজে দিতে পারেন সর্ষে-পোস্ত পুর দিয়ে দু’টো কুমড়ো ফুলের বড়া।

ঘষটে যাওয়া জলছবিতে সে সব কই? কিচ্ছুটি না!

তবু যে মেঘ-ঢলানো দুপুরে চলকে নেমে আসা শিরশিরে বাতাসে লালুর হঠাৎ মনে প়ড়ল জামাইষষ্ঠী, যা সত্যি হতে পারে আবার না-ও হতে পারে, তার কারণ ঝাপটা দিয়ে নাকে আসা মাংসের গন্ধ। লালু যদি লালু না হতেন, যদি তাঁর নাম হত ফারুক আলি, হয়তো বা বকরি ঈদের দুপুর ভেসে উঠত ছবি হয়ে।

গলায়দড়ি পাড়ার এই হোমে এমন অনেকেই আছেন, যাঁদের এক-এক চোখে এক-এক জলছবি। মন যাঁদের নিয়মের নাগাল ছেড়েছে। ডাক্তারি কেতাব বলে, মানসিক ভারসাম্যহীন। আর কিছু ভবঘুরেও। সব মিলিয়ে জনা পঁয়ষট্টি। মাজদিয়ার পাপিয়া কর তাঁদের খাওয়াতে এনেছিলেন ফ্রায়েড রাইস, চিকেন, দই-মিষ্টি, আম। আট বছর ধরে কখনও শিয়ালদহ, কখনও দমদমে জামাইষষ্ঠী আর দুর্গাপুজোয় এ ভাবে খাইয়ে আসছেন বিউটি পার্লার চালানো পাপিয়া। এটাই তাঁর সখ। তাঁর খুচরো সব্জি কারবারি স্বামী বা তাঁদের ক্লাস নাইনে পড়া ছেলেরও এ সব বেশ পছন্দ।

সারা বছর ভারী বুভুক্ষু থাকেন বুঝি হাওয়ায় ঢেউ গোনা এলোমেলো মানুষগুলো? প্রায় হাঁ-হাঁ করে উঠে হোমের কর্তা মোসলেম মুন্সী ধরিয়ে দেন, ফি হপ্তায় মাছ বা মাংস পড়ে পাতে। তবে এ রকম ‘ইস্পেশ্যাল’ খাওয়া তো আর রোজ জোটে না!

বাংলাদেশের রাজশাহী থেকে কী ভাবে যেন ভেসে গিয়ে এই তীরে এসে ঠেকেছিলেন মামুন রশিদ। মাস ছয়েক হল, তাঁর মন নিয়মে ফিরেছে। কিন্তু দেশে ফেরার রাস্তা এখনও খুঁজে পাননি। ভরা পানির দেশে ফেরার জন্য মন তাঁর ভিজে থাকে প্রায়ই। তবু ভোজের সারিতে মুরগি দাঁতে কেটে তাঁর ঠোঁটেও এ দিন চিলতে হাসি।

এক লালুরই খালি বুক টনটন করে— মুখ মনে না পড়া কার জন্য যেন, গোলপানা একটা মুখ... হয়তো বউ, হয়তো শাশুড়ি... কে জানে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন