সিঁধের বাহার দেখেই লোকজন বুঝতেন ‘শিল্পী’ কে 

তস্করেরা মাখনের মতো মসৃণ ভাবে কাজ সেরে রেখে যেত চিহ্ন। সাতসকালে সেই বাহারি সিঁধ দেখে এলাকার লোকজন বুঝতে পারতেন এ কাজ কার!

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০১৮ ০১:২৫
Share:

চোরেদের পৌষ মাস, গেরস্তের সর্বনাশ! দিন বদলেছে। বদলেছে তস্করদের কায়দাও। তবে এ কালের হিন্দি ফিল্মে হাই-টেক কায়দায় চুরি করে বিশেষ বিশেষ চিহ্ন রেখে যায় স্মার্ট চোরেরা। সে কালেও এমন কায়দা ছিল। তস্করেরা মাখনের মতো মসৃণ ভাবে কাজ সেরে রেখে যেত চিহ্ন। সাতসকালে সেই বাহারি সিঁধ দেখে এলাকার লোকজন বুঝতে পারতেন এ কাজ কার!

Advertisement

দুই জেলার বহু প্রবীণদের এখনও মনে আছে সেই সিঁধ-বৃত্তান্ত। তাঁরা জানাচ্ছেন, সিঁধ কাটা ছিল রীতিমতো শিল্প। সিঁধেল চোরদের কাজ দেখতে দেখতে এমন হয়ে গিয়েছিল যে, সিঁধের বাহার দেখলেই বোঝা যেত এ কাজ কোন এলাকার কোন তস্করের। থানা-পুলিশও হতো। কিন্তু প্রমাণের অভাবে জিনিসপত্র কিছুই ফেরত পাওয়া যেত না।

হোগলবেড়িয়ার শঙ্কর মণ্ডল যেমন বলছেন, ‘‘ফলে গোটা শীতকাল জুড়ে আমরাও সতর্ক থাকতাম। তক্কে তক্কে থাকত চোরেরাও। তবে কী জানেন, শেষ পর্যন্ত জিতে যেত চোরেরাই। কাঁহাতক আর ঘর সামাল দিতে রাতের পর রাত জাগা যায়!’’

Advertisement

আবার অন্য ছবিও আছে। মুর্শিদাবাদের ডোমকলে এক বার সিঁধ কাটা সারা। সেই গর্ত দিয়ে ভিতরে মাথাটা পুরোটা গিয়েছে কি যায়নি, খামচে চুল ধরল কে? কে নয়, কারা? সেইসঙ্গে মহিলাদের সমস্বরে চিৎকার, আর মুড়ো ঝাঁটার বাড়ি। এর মধ্যে কে আবার পিছন থেকে টেনে ধরল পা। সে এক কেলেঙ্কারি অবস্থা! তস্কর ধরা পড়ে গেল। তার পরে গাছে বেঁধে উত্তম মধ্যম, সালিশি, মাথা ন্যাড়া করে ঘোল ঢেলে তবেই নিস্তার মিলেছিল। সে যাত্রা আর থানা-পুলিশ করেননি মোল্লাবাড়ির লোকেরা।

নদিয়ার এক তস্কর শিরোমণি এখন অবসর নিয়েছেন। বছর সত্তরের সেই বৃদ্ধ শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে সত্তরের দশকে চুটিয়ে সিঁধ কাটতেন। নতুন লাইনে আসা কত জনকে যে তিনি সিঁধ কাটাতে হাতেখড়ি দিয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। ওপার বাংলার বহু লোকজন ওই বৃদ্ধকে এখনও এক নামে চেনেন। হাসতে হাসতে ওই বৃদ্ধ বলছেন, ‘‘সে এক দিন ছিল রে বাবা। এখনকার মতো তখন বিদ্যুৎ আসেনি। শীতের সন্ধ্যায় কিছুক্ষণ জ্বলত লম্ফ, হ্যারিকেন। তারপরে সব অন্ধকার। শীতের রাতে লোকজন লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লেই আমরা কাজে বেরোতাম। শীত ও বর্ষা ছিল সেরা মরসুম।’’ তবে সে তস্করদের অনেকেই ছিল মাটির মানুষ। তারা নিজেদের শিল্পীই মনে করত। চুরি মানে চুরিই। তার সঙ্গে মারধর কিংবা রক্তপাতের কোনও যোগ ছিল না। এক বার এক চোর সিঁধ কেটে সব গয়না সরিয়ে ফেলেছিল। পরে সে জানতে পারে, মেয়ের বিয়ের জন্যই গয়না কিনে মজুত করেছিলেন গৃহকর্তা। চোরের বড় মায়া হয়। ঠিক একই কায়দায় কয়েকদিনের মধ্যে সে যথাস্থানে সে গয়না ফিরিয়ে দিয়ে এসেছিল। মুর্শিদাবাদের এমনই এক প্রাক্তন তস্কর বলছে, ‘‘এখনকার ছেলেপুলেদের কাজের নমুনা দেখলে ঘেন্না হয়। না তারা শিল্প জানে, না জানে সহবত। এ কাজে নিষ্ঠা ও সততা না থাকলে কোনও ভাবেই সাফল্য আসবে না।

এমন চোরেদের কথা মনোজ বসু লিখে গিয়েছেন তাঁর ‘নিশিকুটুম্ব’ উপন্যাসে। সে উপন্যাসের মূল চরিত্র সাহেব। সে ঢুকেছে চুরি করতে। লেখক তার বর্ণনা দিচ্ছেন—‘ ঘর় অন্ধকার। যত অন্ধকার, তত এরা ভাল দেখে; চোখ জ্বলে মেনি বিড়ালের মতো, সময়বিশেষে বন্য বাঘের মতো। মেয়েটা কালো কি ফর্সা দেখা যায় না, কিন্তু ভরভরন্ত যৌবন। ... বাঁ-হাতটা আদর বুলাচ্ছে, ডান হাতের ক্ষিপ্র আঙুলগুলো ইতিমধ্যে নেকলেশ, চন্দ্রহার, কঙ্কণ একটা একটা করে খুলে সরিয়ে নিল। গা খালি হয়ে গেল— কিছুই টের পায় না মেয়ে, আবেশে চোখ বুজে আছে। হাতের এমনিধারা মিহি কাজ।... আজকাল ওসব নেই, কষ্ট করে কেউ কিছু শিখতে চায় না। নজর খাটো— সামনের মাথায় যা পেল কুড়িয়ে বাড়িয়ে অবসর। কাজেরও তাই ইজ্জত থাকে না— বলে, চুরি-ছ্যাঁচড়ামি।’ (চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন