টর্চ জ্বললেই ছুটতে থাকে গরু

নোট বাতিলের পা পড়েছিল সীমান্তেও, কুয়াশার আড়ালে চুপি চুপি এসে সে বুঝি নিঃসারে নিয়ে গিয়েছিল পাচারের বোলবোলাও। পুরনো নোটে তাই কখনও গরু, কখনও বা সোনা কিনে গোলা ভরেছে সীমান্তের গ্রাম। আর, শীত পড়তেই পদ্মার জলে ফের বিলি কাটছে গরু-কুল। উঁকি মারল আনন্দবাজার। নোট বাতিলের পা পড়েছিল সীমান্তেও, কুয়াশার আড়ালে চুপি চুপি এসে সে বুঝি নিঃসারে নিয়ে গিয়েছিল পাচারের বোলবোলাও। পুরনো নোটে তাই কখনও গরু, কখনও বা সোনা কিনে গোলা ভরেছে সীমান্তের গ্রাম। আর, শীত পড়তেই পদ্মার জলে ফের বিলি কাটছে গরু-কুল। উঁকি মারল আনন্দবাজার।

Advertisement

সুজাউদ্দিন ও সুস্মিত হালদার

শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০১৭ ০২:২১
Share:

অঙ্কন: সুমিত্র বসাক

ঝুপ করে নেমে এল পৌষের সন্ধ্যা।

Advertisement

পদ্মা ও কাঁটাতারের দু’পারে ব্যস্ততা শুরু হয়েছে সেই বিকেল থেকে। ফোনে যাকে যা বলার বলে দেওয়া হয়েছে। সবকিছু তৈরি। এখন শুধু ইশারার অপেক্ষা।

পদ্মা থেকে বেশ কিছুটা দূরে ঘোরাফেরা করছে বেশ কয়েকটি ছায়ামূর্তি। অদূরে বিএসএফ ক্যাম্প কুয়াশায় ঝাপসা। ইনসাস, নাইটভিশন ক্যামেরা নিয়ে জওয়ানরাও তৈরি। কিন্তু গাছগাছালির সঙ্গে মিশে থাকা সে ছায়ামূর্তির দলকে ধরতে পারা কি এতই সহজ!

Advertisement

পদ্মার চরে কুয়াশার বহর দেখে খুশি হয় ওসমান শেখ (নাম পরিবর্তিত)। পাশের জনকে ফিসফিস করে বলে, ‘‘কী মিঞা, শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে কাজ হাসিল হবে তো?’’ বিরক্ত হয় পাশের জন, ‘‘তোমার বাপু সবেতেই মনে কু ডাকে। ভাল কিছু ভাবতে পার না?’’

ওসমানরা দলে পাঁচ জন। পরনে লুঙ্গি, শরীররে সঙ্গে চাদরটা জাপ্টে বাঁধা। মাথা মাফলারে ঢাকা। সকলের পকেটে ফোন। কিন্তু ভাইব্রেট মোডে। খুব বিপদ ছাড়া সে ফোন ব্যবহার করা যাবে না। পাছে মোবাইলের আলো কিংবা কথায় সন্দেহ হয় বিএসএফের। আলো জ্বলবে শুধু টর্চের। তবে একেবারে মাহেন্দ্রক্ষণে।

সে টর্চও এখানকার নয়। দুবাই থেকে আনা। পাঁচ ব্যাটারির টর্চের আলো একবার কারও চোখে পড়লে তিন মিনিট অন্ধকার। ফের ফুট কাটে ওসমান, ‘‘শুধু আলো কেন, বিপদ আপদে ও টর্চ কাজে লাগে কত্তা। ফাইবারের ও জিনিস মাথায় পড়লেও চারদিক আঁধার হয়ে যাবে।’’

রাতের বয়স বাড়তে থাকে। চরাচর জুড়ে একঘেঁয়ে ঝিঁঝিঁর ডাক। লাগোয়া রানিগর, জলঙ্গি থানা এলাকার বেশ কিছু গ্রামে গরু নিয়ে অপেক্ষায় আছে আরও কিছু লোকজন। ইশারার অপেক্ষায়। কুয়াশা ফুঁড়ে, গাছগাছালির মাথার উপর দিয়ে টর্চের তীব্র আলোর অপেক্ষায়। মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায়।

অবশেষে সেই সময় আসে। তীব্র আলোটা মাথার উপরে এঁকে দেয় একটা বৃত্ত। মিনিট কয়েক পরে ফের একবার। ব্যস! গরুর পাল নিয়ে শুরু হয় দৌড়। কুয়াশায় ভেজা বালির চর জুড়ে তখন হয় এসপার নয় ওসপার।

শুধু টর্চের কেরামতিই নয়। কেউ হয়তো দৌড়ে দড় নয়, ভাল দরদামও করতে পারে না। কিন্তু তীক্ষ্ণ শিস দিতে পারে কিংবা অবিকল নকল করতে পারে কুকুর কিংবা শেয়ালের গলা। পাচারকারীদের দলে কদর আছে তাদেরও।

তবে সেখানেও লুকোচুরি আছে। যে দিক থেকে টর্চের আলো মহাশূন্যে পাক খায় কিংবা শিস-শেয়াল-কুকুরের শব্দ আসে সবসময় সে দিক দিয়েই যে গরু কিংবা পাচার সামগ্রী যাবে তারও মানে নেই। কখনও কখনও বেছে নেওয়া হয় তার উল্টো দিক। বিএসএফকে ফাঁকি দিতে কখনও আবার সীমান্তের এক জায়গায় বোমা ফাটিয়ে দেওয়া হয়। সকলে যখন সে দিকে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ঠিক তার উল্টো দিক দিয়ে অবাধে পার হয়ে গেল গরুর দল।

নদিয়ার বিস্তীর্ণ সীমান্ত জুড়ে কাঁটাতারের বেড়া থাকলেও মুর্শিদাবাদের সিংহভাগ এলাকায় সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করে পদ্মা। শীতের সে পদ্মায় এখন জলও বেশি নেই। এ দিকে কুয়াশা রয়েছে ষোলো আনা। আর তারই পুরো সুযোগ নিচ্ছে পাচারকারীরা।

সম্প্রতি জঙ্গিপুরের বাহুড়া সীমান্তে এসেছিলেন ইন্দো-বাংলাদেশ সীমান্ত নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান মধুকর গুপ্তা। তিনিও সীমান্তের পরিকাঠামো ও
পাচার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বিএসএফের এক কর্তাও বলছেন, ‘‘যেখানে কাঁটাতার নেই, সেই সব এলাকায় নজরদারিতে সমস্যা হয়। তাছাড়া কুয়াশা মোকাবিলা করার কোনও যন্ত্র আমাদের হাতে নেই। কখনও কখনও তারই সুযোগ নিচ্ছে পাচারকারীরা।

ইশারার কাজ শেষ হতেই ওসমানরা গ্রামে ফিরেছে। কিন্তু চোখে ঘুম নেই। ওপারে যারা গিয়েছে তারা কখন ফিরবে? ওটা কীসের শব্দ? গুলি নয়তো? কাজ শেষ করে পদ্মা উজিয়ে ওদের ঘরে ফিরতে ফিরতে রাত কাবার হয়ে যায়। ভোররাতে ওসমানের দরজায় টোকা পড়ে। এ আওয়াজ ওসমানের চেনা। নিশ্চিন্ত হয়ে দরজা খুলে দেয়।

নরম চরে পড়ে থাকে শুধু অজস্র পায়ের ছাপ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন