শিলিগুড়ির নিষিদ্ধপল্লিতে পাচার হয়ে যাওয়া বেশ কিছু কিশোরীর সঙ্গে কথা বলেছিলেন একটি অসরকারি সংস্থা কর্মীরা। সেখানে উঠে আসে এক যুবকের কথা। পাচার হওয়া কিশোরীদের মধ্যে ১৫ জন ওই এক যুবকের কথা তাঁদের জানিয়েছিলেন। সেই ছিল পাচার চক্রের অন্যতম মাথা। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, মোবাইল ফোন রিচার্জ করার ফাঁকে সে কিশোরীদের জন্য প্রেমের ফাঁদ পাতত। এটাই ছিল তার ‘মোডাস অপারেন্ডি।’
যখন কোনও কিশোরী তার কাছে ফোন রিচার্জ করাতে আসত তখন ওই যুবক তার ফোন নম্বরটি লিখে রাখত। মিষ্টি কথায় আলাপও জমাতো। পরে সেই নম্বরে ফোন করে যোগাযোগ রাখতে শুরু করত। শুরু হত প্রেমের অভিনয়। অনেক মেয়েই তার কথায় ভুলে ফাঁদে পা দিত। তার পর এক সময় যুবক পালিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিত। প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া অপরিণত মস্তিষ্কের কিশোরীরা তাতে রাজি হয়ে যেত। পালিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখত। কিন্তু তাদের ফুঁসলিয়ে নিয়ে গিয়ে যুবক হাজির করত বিভিন্ন নিষিদ্ধপল্লিতে। মোটা টাকায় বিক্রি করে দিত কিশোরীদের।
ওই অসরকারি সংস্থার কর্মী সৌভিক বসু বলছেন, “এখন নারী পাচারের বিভিন্ন পন্থা বেরিয়েছে। মেয়েদের মধ্যেও এখন ঘর ছাড়ার ব্যাপারে জড়তা অনেক কম। তাঁরা প্রেমের টানে স্বেচ্ছায় রাস্তায় বেরোচ্ছে, তার পর চলে যাচ্ছে অন্ধকার জগতে। সেখানে প্রবল অত্যাচারিত হচ্ছে। পুলিশ বা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গুলি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আর তাদের কাছে পৌঁছাতে পারছে না। তারা চিরদিনের জন্য নিষিদ্ধপল্লিতেই আটকে পড়ছে।”
রাজ্যের মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন লীনা গঙ্গোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘এর হাত থেকে মুক্তির উপায় হল সার্বিক সচেতনতা। মেয়েদের সচেতন হতে হবে, বাড়ির লোককে সচেতন হতে হবে। পুলিশকেও সচেতন হতে হবে।’’
পাচার হয়ে যাওয়া মেয়েদের নিয়ে কাজ করা সমাজকর্মীরা জানাচ্ছেন, এখন পাচারের পথ তৈরির ব্যাপারে বড় ভূমিকা নেয় মোবাইল ফোন ও ফেসবুকের মতো সোস্যাল মিডিয়া। পাচারকারীরা তার মাধ্যমেই মেয়েদের জালে ফেলে। ফলে পুলিশ ও অসকরারি সংস্থা গুলির কাজ আরও কঠিন হয়ে গিয়েছে।
অনেক ক্ষেত্রে আবার কাজ দেওয়ার নাম করে আড়কাঠিরা দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের নিয়ে যায়। পরিবারের আর্থিক স্বাচ্ছন্দের স্বপ্নে বাড়ির লোকও তাতে বাধা দেন না। ভাল করে খোঁজখবরও করেন না যে, মেয়ে কোথায় যাচ্ছে। পরে যখন সব জানতে পারেন তখন লোকলজ্জার ভয়ে পুলিশের কাছে যেতে চান না। বা যখন পুলিশের কাছে যান তখন অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছে। মেয়ে নাগালের বাইরে চলে গিয়েছে।
নদিয়া জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১৭ সালে জেলায় নারী পাচারের ঘটনা ঘটেছে ৭টি, আর ২০১৮ সালে সেটা কমে হয়েছে মোটে দু’টি। কিন্তু সমাজকর্মীরা তা মানতে নারাজ। তাঁদের কথায়, সংখ্যাটা প্রকৃতপক্ষে আরও অনেক বেশি। প্রকৃত পরিসংখ্যান উঠে আসছে না। বা চেপে দেওয়া হচ্ছে। কারণ? সমাজকর্মী রীণা মুখোপাধ্যায় বলছেন, “বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মেয়ে হারানোর অভিযোগে পুলিশ নিখোঁজ অথবা অপহরণের মামলা করে। কিন্তু আইনে পাচারের ঘটনার জন্য ইটপা বা ‘ইম্মরাল ট্যাফিকিং প্রিভেনশন অ্যাক্ট’ আছে। মামলায় সেই ধারা না-দেওয়ার জন্যই পাচারের প্রকৃত পরসংখ্যান উঠে আসে না।” যদিও জেলার পুলিশ সুপার রূপেশ কুমার দাবি করেছেন, “যেমনটা অভিযোগ হয় সেই মতোই ধারা দেওয়া হয়। পরে তদন্তে যেমন তথ্য উঠে আসে সেই মতো পদক্ষেপ করা হয়।” তিনি আরও দাবি করেছেন, নদিয়া জেলায় পাচারের ঘটনা আর তেমন ঘটছে না।