Nurse Dipali Jana Death Case

নন্দীগ্রামে লড়াই শুরু, সিঙ্গুরে শেষ! দেহ এসেছিল জন্মাষ্টমীতে, পুজোর মন্ত্রোচ্চারণ পৌঁছোয় না দীপালির হোগলাকাঠির ঘরে

দেহদখল ঘিরে রাজনৈতিক আকচাআকচি হয়েছে। এক বছর আগের স্মৃতি উস্কে কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেছেন, ‘আর একটা আরজি কর!’ কিন্তু আলোড়ন হয়নি। তবে ওলটপালট হয়েছে। ওলটপালট হয়ে গিয়েছে একটি গোটা পরিবার।

Advertisement

শোভন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০২৫ ০৭:৫৬
Share:

দীপালি জানা। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

প্রায় দু’দশক হতে চলল! দেড়শো কিলোমিটারের দূরত্বের দুই জনপদের নাম উচ্চারিত হত একই বন্ধনীতে। নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম। হুগলি এবং পূর্ব মেদিনীপুরের যে দুই জনপদকে ঘিরে বেনজির আলোড়ন দেখেছিল পশ্চিমবঙ্গ। যে দুই জনপদ ওলটপালট করে দিয়েছিল বাংলার রাজনীতির সাড়ে তিন দশকের ‘স্থিতাবস্থা’।

Advertisement

২০২৫ সালের অগস্টে সেই দুই জনপদ আবার এল একই বন্ধনীতে। ‘নন্দীগ্রামের নার্সের রহস্যমৃত্যু সিঙ্গুরের নার্সিংহোমে’। সেই নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর। সেই সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম।

দেহের দখল ঘিরে রাজনৈতিক বাম-বিজেপির আকচাআকচি হয়েছে শ্রীরামপুর ওয়ালশ হাসপাতালে। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের মর্গের সামনে ১৫ অগস্ট বিকালে হাতাহাতি হয়েছিল দু’পক্ষের। এক বছর আগের স্মৃতিকে উস্কে কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেছিলেন, ‘আর একটা আরজি কর!’ কিন্তু আলোড়ন হয়নি। তবে ওলটপালট হয়েছে। ওলটপালট হয়ে গিয়েছে একটি পরিবার।

Advertisement

নন্দীগ্রামের গোকুলনগর ৬ নম্বর অঞ্চলের রায়নগর গ্রামের একটি পুকুরপাড়। সেই পুকুরপাড়ে টালির চালের ঘর। দেওয়ালে বাঁশের কাঠামোর মাঝে হোগলাকাঠি দেওয়া। স্যাঁতসেঁতে মাটির মেঝে। এই ঘর থেকেই স্বপ্ন দেখেছিলেন ২৪ বছরের দীপালি জানা। নার্স হবেন। টোটোচালক বাবা তাঁকে পড়াতে ঋণের জালে জড়়িয়ে পড়েছেন। বাবাকে ঋণমুক্ত করবেন। বেঙ্গালুরুর নার্সিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে শংসাপত্র আসার আগেই যোগ দিয়েছিলেন কাজে। মাস চারেক হুগলির একটি নার্সিংহোমে ডায়ালিসিসের ‘ট্রেনিং’। তার পর সিঙ্গুরের নার্সিংহোমে শিক্ষানবিশ হিসাবে কাজ শুরু। সেখানেই ১৩ অগস্ট রাতে তাঁর ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয়েছিল।

গোপালপুজো করতেন দীপালি। বাড়িতে রাখা গোপালঠাকুরের জন্য অনলাইনে বরাত দিয়ে কিনতেন পোশাক। অগস্টের ১২ তারিখে বাড়িতে জানিয়েছিলেন, জন্মাষ্টমীর দিন গোপালপুজোর জন্য বাড়ি ফিরবেন। সিঙ্গুর থেকে নন্দীগ্রামে। করে ফেলেছিলেন দুগ্গাপুজোর পরিকল্পনাও। সহকর্মীর সঙ্গে ‘চুক্তি’ ছিল, অষ্টমীর কাকভোরে সিঙ্গুর থেকে যাবেন নন্দীগ্রামে। গ্রামে পৌঁছে রায়নগর বারোয়ারির মণ্ডপে অঞ্জলি দেবেন। যেমনটা দিয়ে এসেছেন এত বছরের পুজোয়। পুজোর সকালে যখন সেই রায়নগর বারোয়ারি থেকে ভেসে আসছে মন্ত্রোচ্চারণ, তখন ফ্রেমবন্দি দীপালির ছবিতে মালা পরিয়ে দিচ্ছেন মা মায়ারানি।

যাটের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাওয়া দীপালির বাবা সুকুমার আগে জনমজুরের কাজ করতেন। বছরখানেক হল মেয়ের চাপে একটি পুরনো টোটো কিনেছিলেন। সেটিই চালান। মেয়ের মৃত্যু ঘিরে এখনও তাঁর অসংখ্য প্রশ্ন। তিনি বিশ্বাস করেন না, এটি একটি মামুলি আত্মহত্যা।

নন্দীগ্রামের মূল রাস্তা থেকে ডান দিকে নেমে গেলে গোকুলনগরের রায়নগর গ্রাম। আর একটু এগোলেই তেখালি ব্রিজ। যে ব্রিজের লাগোয়া মাঠ রক্তাক্ত ইতিহাসের সাক্ষী। ২০০৭ সালের ১৪ মার্চ পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে নন্দীগ্রামে মৃত্যু হয়েছিল ১৪ জনের। তখন বছর চল্লিশের সুকুমার ছিলেন জমি আন্দোলনকারী। সেই তিনি এখন বলছেন, ‘‘আমরা আন্দোলন করা লোক। আমরা জানি কত কিছু এদিক-ওদিক হয়। আমার মেয়ের দেহ যে ভাবে নার্সিংহোমের লোকেরা রাতারাতি সরিয়ে দিয়েছিল, তাতেই স্পষ্ট ওটা আত্মহত্যা নয়।’’

পরিবারের দাবি মেনে দীপালির দেহের ময়নাতদন্ত হয়েছিল কল্যাণী এমসে। তাতে খুন বা অন্য কিছুর ইঙ্গিত মেলেনি।

হোগলাকাঠি আর টালির চালের ঘরের ভিতর পাতা চৌকিতে বাবু হয়ে বসে সুকুমার বলছিলেন তাঁর মেয়ের লড়াইয়ের কথা। টালির চালে একাধিক কাপড়ের তাপ্পি দেওয়া সিলিং। সেই সিলিংয়ে কোনও পাখা নেই। কলকাতার ফুটপাথে খাবারের দোকানে উনুনে হাওয়া দেওয়ার জন্য যেমন ছোট পাখা থাকে, তেমনই একটি পাখা রাখা চৌকির উপর। এক পাশে উঁচু আলমারি। তার মাথা কাপড়ের সিলিং ফুঁড়ে উঠেছে। বাবার মুখে কন্যার লড়াইয়ের কথা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, আলমারিটিই দীপালির যুদ্ধের প্রতীক। অকালমৃতা মেয়ে ফুঁড়ে দিতে চেয়েছিলেন আজন্মের দৈন্য, বাবার দেনা, মায়ের কষ্ট।

১৩ অগস্ট রাত ১১টা নাগাদ সিঙ্গুর থেকে নন্দীগ্রামের গোকুলনগরের মাটির ঘরে প্রথম ফোন গিয়েছিল। গভীর রাতে সেই প্রত্যন্ত এলাকায় গাড়ি পাওয়া কঠিন। তবুও পড়শিদের ডাকাডাকি করে একটি গাড়ির ব্যবস্থা করে সুকুমার-মায়ারানি তাড়াতাড়ি রওনা দিয়েছিলেন সিঙ্গুরে। ভোর ৪টে নাগাদ নার্সিহোমে পৌঁছে তাঁরা সেখানে মেয়ের দেহ দেখতে পাননি। তার মধ্যেই দেহ নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বড়া বিট হাউসে (সিঙ্গুর থানার অন্তর্গত)। সেখান থেকে ওয়ালশ হাসপাতাল, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ এবং কল্যাণী এমস— তিনটি হাসপাতালের তিনটি লাশকাটা ঘরে ঘুরেছে দীপালির দেহ। তিন দিন ধরে।

দীপালির ২২ বছরের ভাই সুব্রত পরিযায়ী শ্রমিক। অগস্টের গোড়ায় কাজ করতে চলে গিয়েছিলেন চেন্নাই। দিদির মৃত্যুর খবর পেয়ে ফিরে আসেন। প্রবাসী ভাইয়ের সঙ্গেও পুজোর ‘বোঝাপড়া’ সেরে ফেলেছিলেন দীপালি। তিনি বাবা-মাকে পুজোয় নতুন পোশাক কিনে দেবেন। তাঁর নতুন জামা তিনি নেবেন ভাইয়ের কাছ থেকে। নার্সিং প্রশিক্ষণ শেষে কাজে যোগ দেওয়ার পরে এটিই ছিল দীপালির প্রথম পুজো। নিজে পায়ে দাঁড়ানোর পরে প্রথম পুজো।

দীপালি কি প্রণয়ঘটিত কোনও কারণে মানসিক চাপে ছিলেন? তাঁর মৃত্যুর পরে এক যুবককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। সুকুমার অবশ্য বলছেন, ‘‘দেড় মাস আগেও ওকে বলেছিলাম, তোর যদি নিজের কাউকে দেখা থাকে, আমাদের বলিস। কিন্তু মেয়েটা আমার একটাই কথা বলত, আগে তোমায় দেনামুক্ত করি। তার পর বাকি সব ভাবা যাবে।’’

শুনতে পেয়ে ঘরের লাগোয়া বারান্দায় একচিলতে রান্নার জায়গা থেকে রান্না ফেলে উঠে এলেন দীপালির মা। মায়ারানি বলতে থাকলেন, ‘‘আমাদের গেরামে বাড়িতে বিয়ের বয়সি মেয়ে থাকলে ঘটক আসে। আমাদের বাড়িতেও এসেছিল। কিন্তু মেয়ে জানতে পেরে মাঝরাস্তায় তাকে ধরে শাসিয়ে দিয়েছিল, খবরদার যেন বিয়ের কথা বলতে না-আসে।’’

ততক্ষণে সুকুমার আলমারির পাশ থেকে বের করেছেন একটি ডায়েরি। দীপালির ডায়েরি। তাতে নার্সিং প্রশিক্ষণের নানাবিধ নোট্। আর পাতায় পাতায় ‘প্রভু’র কাছে তাঁকে উদ্ধারের আর্জি। তেমনই একটি পাতায় বাবার উদ্দেশে মুক্তোর মতো হস্তাক্ষরে লেখা, ‘স্বপ্ন তো আমার অনেক আছে। কিন্তু আমার প্রথম আর শেষ স্বপ্ন হল, বাবাকে সাহায্য করা।’ শেষ লাইনে, ‘বাবা, তুমি চিন্তা কোরো না। আমি ঠিক তোমাকে সাহায্য করব।’

দীপালি স্নাতক হয়েছিলেন নন্দীগ্রামের সীতানন্দ কলেজ থেকে। তার পরে হলদিয়ায় ভর্তি হন নার্সিং প্রশিক্ষণের জন্য। বেঙ্গালুরুতে পরীক্ষা দিতে যেতে হত। সুকুমার চেষ্টা করেছিলেন, যাতে রাজ্য সরকারের স্টুডেন্টস ক্রেডিট কার্ডে ঋণ পাওয়া যায়। কিন্তু দু’টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে হত্যে দিয়ে পড়ে থেকেও ঋণ মেলেনি। অগত্যা একাধিক ছোট সংস্থা থেকে চড়া সুদে ঋণ নেওয়া। একটা ঋণ শোধ হওয়ার আগেই চলে আসত মেয়ের নতুন সিমেস্টার। ফের নতুন করে ঋণের জালে জড়ানো। ঋণে ডুবছেন জানলেও সুকুমার ভরসা পেতেন মেয়ের কথায়, ‘‘বাবা, তুমি আমাকে পড়াও। আমি চাকরি পেয়ে সব ঠিক করে দেব।’’

চাকরি পেয়েছিলেন দীপালি। শুরু করেছিলেন টাকা পাঠানোও। সুদিনের স্বপ্ন বোনা শুরু হয়েছিল হোগলাকাঠির স্যাঁতসেঁতে ঘরে। মেয়ের হাত ধরেই ঋণমুক্ত হওয়ার ভরসা পেতে শুরু করেছিলেন সুকুমার। কিন্তু নন্দীগ্রামের নার্সের ‘রহস্যমৃত্যু’ হল সিঙ্গুরের নার্সিংহোমে। গোপালের পুজোয় মেয়ের দেহ পৌঁছেছিল বাড়িতে। দুর্গাপুজোর অঞ্জলির মন্ত্রোচ্চারণ পৌঁছোয় না সুকুমার-মায়ারানির ঘরে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement