Coronavirus in America

ঋণ মেটাতে বাগানে পাতা তুলছে পড়ুয়া

ফোন ধরার সুযোগ কমে গিয়েছে মুকেশের। কারণ, সে এখন বাড়ির কাছে বাগানে নতুন চা গাছ রোপনে ব্যস্ত।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৩ জুন ২০২১ ০৫:৫৩
Share:

বাগানে কাজ করছে মুকেশ। মাদারিহাটে। নিজস্ব চিত্র।

মাথা গোঁজার ঠাঁইটা একটু পাকাপোক্ত করতে চেয়েছিলেন বাবা-মা। তাই বেসরকারি একটি ব্যাঙ্ক থেকে কিছু টাকা ঋণ করতে হয়েছিল তাঁদের। সেই টাকায় ঘরের সবটা পাকাপোক্ত হয়নি ঠিকই, কিন্তু চারদিকটা কংক্রিটের আধা দেওয়ালে মুড়ে ফেলা গিয়েছিল। তার মাঝে থেকেই অনেক আশা নিয়ে বুক বাঁধছিলেন দম্পতি। সংসার টানতে বড় ছেলেকে কাজে নামতে হলেও, হাইস্কুলে পড়া ছোট ছেলেকে নিয়ে দু’জনেরই ছিল একরাশ স্বপ্ন।

Advertisement

কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে সেই স্বপ্নও চুরমার হওয়ার জোগাড়।

বাড়ির ছোট ছেলে মুকেশ খাড়িয়া মাদারিহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়া। গত বছর লকডাউনে স্কুলের অনলাইনে ক্লাসে পড়াশোনা শুরু হয়েছিল। টানাটানির সংসারেও ছেলেকে স্মার্ট ফোন কিনে দিয়েছিলেন বাবা-মা। সেই ফোনটি আজও মুকেশের কাছে থাকে। শিক্ষকদের ‘ডাকে’ মাঝেমধ্যেই বেজে ওঠে সেটি। কিন্তু সেই ফোন ধরার সুযোগ কমে গিয়েছে মুকেশের। কারণ, সে এখন বাড়ির কাছে বাগানে নতুন চা গাছ রোপনে ব্যস্ত। মুকেশের কথায়, “বাবা এখনও রোজ কাজে বের হন। দাদাও কাজ করতে যায়। তার পরেও করোনা আবহে সবটাই যেন এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। আগের মতো আয় নেই। ব্যাঙ্ক ঋণ মেটানোও চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই আমাকেও চা বাগানে কাজ নিতে হয়েছে।’’ তবে মুকেশ এখনও পড়াশোনা ছাড়েনি। তার কথায়, ‘‘শুধু অনলাইন ক্লাসে সমস্যা হয়। তখন তো বাগানের কাজ থাকে।”

Advertisement

নাগরাকাটার আবাসিক একলব্য মডেল স্কুলের অধ্যক্ষ অমরজিৎ সিংহ চৌহান বলেন, “পড়াশোনার অনলাইন ব্যবস্থায় অনেক চা বাগানের পড়ুয়াই স্বচ্ছন্দ নয়।” যা নিয়ে সরব চা বলয়ের বাসিন্দাদের অনেকেই। তাঁদের কথায়, অনেক কষ্টে বাবা-মা পড়ুয়াদের স্মার্ট ফোন কিনে দিচ্ছেন। কিন্তু তাতে কী! চা বলয়ে নেটওয়ার্ক পাওয়াটা খুবই কঠিন। স্কুলও দীর্ঘদিন বন্ধ। ফলে কেউ বাড়ির হাল সামলাতে, তো কেউ আবার নিজের দু’বেলার খাবার জোগানের তাগিদে ডুয়ার্স ও তরাইয়ের বাগানে দৈনিক কাজে লেগে গিয়েছে।

শিলিগুড়ি মহকুমার থানঝোরা চা বাগানের বাসিন্দা শচীন ওরাওঁ খড়িবাড়ি হাইস্কুলে একাদশ শ্রেণিতে পড়ে। তার কথায়, “স্কুল বন্ধ, ক্লাস হয় না। বাড়িতে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। তাই ঘরে বসে না থেকে সুযোগ পেলেই চা পাতা তুলতে যাই।” নকশালবাড়ি নন্দপ্রসাদ হাইস্কুলের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র কপিল ওরাওঁ আবার বলে, “স্কুল নেই, পড়াশোনা নেই। যতটা পড়েছি, তা-ও ভুলতে বসেছি।’’

মাদারিহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নারায়ণ সরকার বলেন, ‘‘এখন অভাবের তাড়নায় পড়ুয়াদের অনেকেই চা বাগানে অস্থায়ীভাবে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। তাদের এবং অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে প্রত্যেককে পড়ায় ফেরানোর চেষ্টা করছি। আলিপুরদুয়ারের বিদ্যালয় পরিদর্শক (মাধ্যমিক) আশানুল করিমও বলেন, “এই পরিস্থিতির জন্য পড়ুয়াদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা বড় কারণ। তবু ওই পড়ুয়াদের সকলকে বুঝিয়ে যাতে পড়াশোনার ব্যস্ততায় ফিরিয়ে আনা যায়, শিক্ষক-শিক্ষিকারা সেই চেষ্টাই করছেন।”

বর্তমান পরিস্থিতিতে তফসিলি জনজাতি প্রধান চা বলয়ের পড়ুয়াদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন রাজ্যের অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দফতরের স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী বুলুচিক বরাইকও। যিনি নিজেও চা বলয়ের বাসিন্দা। মন্ত্রী বলেন, “স্মার্ট ফোন নেই অনেকের। স্বভাবতই উচ্চ শিক্ষার প্রতি তাদের উৎসাহ কমবে।”

(প্রতিবেদন: পার্থ চক্রবর্তী, কৌশিক চৌধুরী, মালবাজার থেকে সব্যসাচী ঘোষ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন