ঢাক বাজিয়ে তৃণমূলের প্রচার শিলিগুড়িতে। রবিবার তোলা নিজস্ব চিত্র।
কেউ মিছিলের শুরুতে নিজেই ঢাকের কাঠি হাতে তুলে নিলেন, কেউ অক্লান্ত ভাবে কর্মী-সমর্থকদের হাজারো অনুরোধ মেনে চললেন। আবার হুডখোলা জিপ তৈরি থাকলেও, কাউকে দেখা গেল কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে চড়া রোদে হেঁটে যেতে।
আগের দু’দিনের মতো বৃষ্টির আশঙ্কা ছিল না। কালো মেঘ সরিয়ে সকাল থেকেই রোদ ঝলমলে আকাশ। তায় ভোটের আগে শেষ রবিবার। গত শুক্র ও শনিবার দমকা হাওয়া-বৃষ্টিতে ডান-বাম সব দলেরই একাধিক সভা ভেস্তে গিয়েছিল। প্রচারের সেই ক্ষতিই যেন পুষিয়ে নিতে রবিবারের ছুটির দিনে কর্মী-সমর্থক, ভোটপ্রার্থীদের সঙ্গে সমান উৎসাহে প্রচার চালালেন নেতারাও। এ দিন ডান-বাম সব দলই ঢাক-ঢোল বাজিয়ে, দলের পতাকার রঙে এত তাড়া বেলুন সামনে রেখে মিছিল সাজিয়েছিল। উৎসবের মেজাজে সেই সব মিছিলে নেতাদেরও দেখা দেল অন্য ভাবে। তবে সুর চড়িয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে তীব্র অভিযোগ আনতে ছাড়েননি কেউই।
এ দিন সকালে সেবক রোড লাগোয়া একটি এলাকা থেকে তৃণমূল প্রার্থীর সমর্থনে মিছিলে ঢাক-ঢোল বেলুন সবেরই আয়োজন করা ছিল। মন্ত্রী গৌতমবাবু এসে পৌঁছনোর পরেই শুরু হয় ঢাক বাজানো। মন্ত্রী নিজেই এগিয়ে এসে একটি ঢাক বাজাতে শুরু করেন। মন্ত্রীর হাতে ঢাকের কাঠি দেখে, কর্মী সমর্থকদের অনেকেই মোবাইল বের করে ছবি তুলতে শুরু করেন। হাসি মুখে দাঁড়াতে দেখা গিয়েছে মন্ত্রীকে। ২৬ এবং ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে জিপে চড়ে প্রচার চালিয়েছেন গৌতমবাবু। সন্ধ্যের পরে বেশ কয়েকটি এলাকাতে ঘরোয়া সভাও করেছেন গৌতমবাবু। শহরের প্রীতিলতা রোড থেকে তৃণমূল প্রার্থী কৃষ্ণ পালের সমর্থনে মিছিল বের হয়ে ২৩ নম্বর ওয়ার্ড পরিক্রমা করে। মিছিলে মন্ত্রী গৌতমবাবু ছাড়াও তৃণমূল নেত্রী মহুয়া মৈত্র, জেলার সাধারণ সম্পাদক মদন ভট্টাচার্য ছিলেন। বিকেলে এ দিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ১২টি ওয়ার্ডে প্রচার চালিয়েছেন মন্ত্রী।
কর্মী-সমর্থকদের আবদার মেটাতে দেখা গিয়েছে প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্যকেও। অশোকবাবু নিজেই এবার ৬ নম্বর ওয়ার্ড থেকে প্রার্থী। বামেদের মেয়র পদপ্রার্থীও অশোকবাবু। ‘নিজের’ ৬ নম্বর ওয়ার্ড ছাড়াও অন্য কর্মী-সমর্থকদের দাবি মেটাতে সব ওয়ার্ডেই যেতে হচ্ছে অশোকবাবুকে। এ দিন পালপাড়া, সংহতি মোড় এলাকায় পরপর দু’টি মিছিল করে কলেজপাড়ায় গিয়ে একটি মিছিল করেছেন অশোকবাবু। কর্মী সমর্থকদের অনুরোধে দলের প্রতীক চিহ্ন ছাপা লাল রঙের টুপিও পড়ে নেন তিনি। সে সময়েই এক কর্মী এসে ছবি তোলার জন্য, অশোকবাবুকে টুপিটি ঘুরিয়ে পড়তে অনুরোধ করেন। ওই কর্মীকে নিরাশ করেননি তিনি। কলেজ পাড়ার একটি বাড়ির ভিতরে শিশুকে হাত নাড়তে দেখে মিছিল থেকে বের হয়ে আদরও করে এসেছেন প্রাক্তন পুরমন্ত্রী। তাঁর কথায়, ‘‘এ বার ভোটে কর্মী সমর্থকদের মধ্যে বিপুল উৎসাহ তৈরি হয়েছে। এই স্বতঃস্ফূর্ত মেজাজটাই প্রার্থীদের চাঙ্গা করেছে। কাউকে নিরুৎসাহ করছি না। কর্মীদের আবেগকে মর্যাদা দিতে হবে।’’
রাজ্যের প্রাক্তন, বর্তমান দুই মন্ত্রীর মতো ভিন্ন মেজাজে দেখা গেল দার্জিলিঙের বিজেপি সাংসদ সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়াকেও। গত শুক্রবার থেকে তিনি ভোর বেলায় প্রাতঃভ্রমণ দিয়ে জনসংযোগ শুরু করেছেন। এলাকা বেছে নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় চায়ের আসরেও যোগ দিচ্ছেন তিনি। হুডখোলা জিপে চেপে রোড-শোও করছেন তিনি। এ দিন সকাল দশটা নাগাদ পঞ্জাবি পাড়া লাগোয়া সেবক রোড থেকে রোড শো শুরু হওয়ার কথা ছিল সাংসদের। সেই মতো কালো রঙের হুডখোলা জিপও তৈরি রাখা হয়েছিল। রোড শো শুরু হওয়ার কথা ছিল সকাল সাড়ে ৯টায়। যদিও, রোড শো শুরু হল তার প্রায় ঘণ্টা দেড়েক পরে। ততক্ষণে চড়া রোদ। হুডখোলা জিপের উপরে ছাতা লাগানোরও চিন্তাভাবনা শুরু করেছেন কর্মী-সমর্থকরা। যদিও, সাংসদ পৌঁছে কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গেই হাঁটতে শুরু করলেন। হুড খোলা জিপে ওঠার অনুরোধ করলে, কর্মীদের তিনি বলেন, ‘‘সকলের সঙ্গে আমিও হাঁটব।’’ এরপরে আরও চারটি ওয়ার্ডের রোড শোতেও জিপের অনুরোধ সরিয়ে মিছিলে হেঁটেই জনসংযোগ করেছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘কোনও মিছিলে ঢাক বাজছে, কোথাও বেলুন নিয়ে কর্মীরা হাততালি দিচ্ছেন, উৎসবের মতো পরিবেশে প্রচার হয়েছে।’’
ছুটির সকালে বাড়ি-বাড়ি প্রচারেই জোর দিয়েছিলেন জেলা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক সুজয় ঘটক। ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের কংগ্রেস প্রার্থী সুজয়বাবু এ দিন সকাল থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়াম লাগোয়া বিভিন্ন এলাকায় প্রচার করেছেন। এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে এলাকার সমস্যা নিয়েও আলোচনা করেছেন তিনি। জেলা কংগ্রেস সভাপতি (সমতল) শঙ্কর মালাকারও এ দিন দলের প্রার্থীদের সমর্থনে কোথাও পদযাত্রা কোথাও পথসভা করেছেন। সকালে তিনি ৮ এবং ৯ নম্বর ওয়ার্ডে পদযাত্রা করেন। রবীন্দ্রনগর এবং হায়দারপাড়ার লালা লাজপত রায় রোডেও শঙ্করবাবু দু’টি পদযাত্রা করেন। বিকেলে দক্ষিণ আম্বেদকর নগরে দলের প্রার্থীর সমর্থনে পথসভা করেছেন শঙ্করবাবু।
কলকাতার পুরভোট নিয়ে রবিবার শিলিগুড়িতে দলের প্রচারে এসে বিজেপির সর্বভারতীয় সম্পাদক সিদ্ধার্থনাথ সিংহ বলেন, ‘‘কলকাতায় পুরভোটে গণতন্ত্র হত্যা হয়েছে। ২৫ এপ্রিলও হবে। কলকাতায় তার ‘ট্রেলর’ দেখা গেল।’’ তাঁর কথায় মুখ্যমন্ত্রী কলকাতাকে লন্ডন বানাবেন বলেছিলেন, নরক বানিয়ে দিয়েছেন। পুলিশ প্রশাসন তৃণমূলের অফিসিয়াল এজেন্ট হয়ে কাজ করছে। সংবিধান যিনি রক্ষা করেন, সেই রাজ্যপাল দেখুন।’’ সেই সঙ্গে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘‘মনে রাখতে হবে ২০১৬ সালে যে বিধানসভা নির্বাচন হবে, সেখানে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন থাকবে। কেন্দ্রীয় সেনা থাকবে। মমতা দিদির রাজত্ব চলবে না।’’
তিনি বলেন, ‘‘আমরা নিজস্ব উদ্যোগে বহু জায়গায় ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার ব্যবস্থা করেছি। পুলিশ কী করছে রেকর্ড হবে। আইনকে এ ভাবে শেষ করতে দেব না। রেকর্ডে এসপি, আইসি’রা কী করছেন তার মধ্যে খারাপ কিছু দেখলে হাইকোর্টে যাব। কোর্ট থেকে আদেশ দিলে সেই এসপি, আইসি-র চাকরি যাবে।’’
বিজেপি নেত্রী অভিনেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায় বলেন, দলীয় কর্মীদের সঙ্গে শিলিগুড়িবাসীদেরও তৃণমূলের সন্ত্রাসের মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত থাকার জন্য আহ্বান জানান। রবিবার শিলিগুড়িতে প্রচারে দলীয় কর্মীদের তিনি বলেন, ‘‘তৃণমূল মারবে। আপনাদের সতর্ক করছি। প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত হন।’’
সিপিএম সাংসদ ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ও এ দিন দিনভর প্রচারে গিয়ে বলেন, ‘‘কলকাতা পুর নির্বাচনে পুলিশের পোশাকে তৃণমূলের গুণ্ডাবাহিনী ভোট করতে সাহায্য করেছে শাসকদলকে। নির্বাচন কমিশনও তৃণমূলের হাতের পুতুলে পরিণত। তাঁরা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন, নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হয়নি।’’ এই প্রসঙ্গে তিনি এসজেডিও-র ২০০ কোটি টাকার দুর্নীতির উল্লেখও করেন।
তবে মন্ত্রী গৌতমবাবুর বক্তব্য, ‘‘বিজেপিকে আমরা গুরুত্ব দিই না। তবে সিদ্ধার্থনাথবাবু যদি ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা লাগানোর কথা বলে থাকেন, তা হলে আমরা নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগ জানাব। কেননা, এই ভাবে কেউ নজরদারি করতে পারে না।’’