নোট বুক

কখনও হুমকি, কখনও মিষ্টি ব্যাঙ্কের জীবনে

৮ নভেম্বর টিভি-তে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা দেখে প্রথম জানতে পারি, রাত বারোটার পর থেকে বাতিল হতে চলেছে পাঁচশো আর হাজার টাকার নোট। এর পরেই আসে অফিসের ডাক।

Advertisement

অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, শিলিগুড়ির রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক

শেষ আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০১৬ ০১:৪৪
Share:

৮ নভেম্বর টিভি-তে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা দেখে প্রথম জানতে পারি, রাত বারোটার পর থেকে বাতিল হতে চলেছে পাঁচশো আর হাজার টাকার নোট। এর পরেই আসে অফিসের ডাক। পর দিন ব্যাঙ্ক বন্ধ। কিন্তু জরুরি মিটিংয়ের জন্য আমাদের সাতসকালেই ব্যাঙ্কে যেতে হয়। সবটাই তখন ধোঁয়াশা আমাদের কাছে। তারও পর দিন থেকে শুরু হল লড়াই। লম্বা লাইন দিয়ে টাকা বদল আর টাকা তোলার পালা। যা অন্য সময়ের থেকে দশ, এমনকী পনেরো গুণ! আমাদের ব্যাঙ্কের গ্রাহক নন, এমনও অনেকে আসছেন ব্রাঞ্চে, নোট বদলাতে। সব মিলিয়ে রোজ সাতশো, আটশো জন তো হচ্ছেই।

Advertisement

আর এই ভিড় সামাল দিতে আমাদের কানে একটাই বীজমন্ত্র দিয়ে রেখেছেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ— হাসি মুখে এবং মুখ বুজে কাজ করে যান। কান দিন তুলো, পিঠে বাঁধুন কুলো। ব্যস! পরিমাণ মতো টাকা নেই। প্রয়োজন মতো কর্মী নেই। তবু গত সাত-আট দিন ধরে নাওয়া-খাওয়া ভুলে এই মন্ত্রেই আমরা ব্রাঞ্চ সামলে চলেছি।

ঢাল-তলোয়ারের অবস্থা কেমন? শিলিগুড়ির বর্ধমান রোডে আমাদের ছোট ব্রাঞ্চ। স্টাফ সাকুল্যে পাঁচ জন। তার মধ্যে এক মহিলা কর্মীর সামনেই বিয়ে। সে জন্য ঠিক ছিল, ১০ নভেম্বর থেকে ছুটি নেবেন। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে ছুটি নেবেন কী করে! সব ছুটিই তো বাতিল। আবার বিয়ের ছুটি পাবেন না, তা-ই বা কী করে হয়! শেষে তিনি ছুটি পেলেন, তবে এক দিন পরে।

Advertisement

ছোট ব্রাঞ্চে দু’একটির বেশি টাকা গোনার মেশিন থাকে না। আমাদের যা আছে, তাতে এই পরিস্থিতিতে কাজ চালানো কঠিন।

এই অবস্থায় এক এক জন এনে ফেলছেন ১৫-২০ হাজার বা আরও বেশি টাকা। সেই নোট গুনতে হচ্ছে। তাতে জাল নোট আছে কি না, দেখতে হচ্ছে। আবার লোক দাঁড় করিয়েও রাখা যাচ্ছে না বেশিক্ষণ। তা হলেই উড়ে আসছে নানা মন্তব্য। সে সব শুনতে হচ্ছে কিন্তু মুখে হাসি রেখেই।

একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। এক দিন লাইনে দাঁড়িয়ে এক বৃদ্ধ বুকে হাত দিয়ে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘‘আমার বুক প্রচণ্ড ব্যথা করছে। শরীর খারাপ লাগছে। আমাকে শিগগির টাকা দিন। কিছু যদি হয়ে যায় তবে আপনারাই দায়ী হবেন কিন্তু!’’

সঙ্গে সঙ্গে পিছন থেকে আর এক জন চেঁচিয়ে উঠল, ‘‘সব মোবাইলে তুলে রাখ!’’ ক্রিকেটে যাকে বলে রি-অ্যাকশন টাইম, সেই সামান্য সময়ের মধ্যে ভেবে নিলাম কী করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে একজন চলে গেল বৃদ্ধের কাছে। তাঁকে একটি চেয়ার বসিয়ে, চোখে-মুখে জল দিয়ে ঠান্ডা করা হল। বোঝানো হল, এ ভাবে চেঁচিয়ে লাভ কী! তাতে তো কাজের কাজ কিছু হবে না। শেষ অবধি তিনি একটু অপেক্ষা করে টাকা পেলেন।

রোজ তিনটে লাইন সামলাতে হচ্ছে আমাদের। একটি লাইন নোট বদলানোর। অন্য দু’টি টাকা তোলার এবং জমা দেওয়ার। তিন জন কর্মী এই তিন লাইন সামলাতে ব্যস্ত। মুখ তোলার সময় নেই কারও। তার মধ্যেই টুকটাক মন্তব্য কানে আসছে। এক দিন কানে এল, লাইনে দাঁড়িয়ে এক জন আর এক জনকে বলছেন, ‘‘গিন্নি লুকিয়ে চুরিয়ে ২০ হাজার টাকা জমিয়ে রেখেছিল। এখন এই টাকা জমা দিতে দিন কাবার। দেখুন তো কী সমস্যা!’’ শুনে অন্য জন বললেন, ‘‘আমার দাদা, টাকাটা আরও বেশি!’’

আবার কখনও ছিটকে আসছে নানান হুঁশিয়ারি। টাকার জোগান পর্যাপ্ত নয়। তাই লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা সকলেই যাতে কিছু টাকা পান, সে ভাবে হিসেব করে টাকা দিচ্ছি আমরা। তাতেও বিপত্তি। কেউ বলছেন, ‘‘ঘোষণা হয়েছে ৪ হাজার করে মিলবে। কম দিচ্ছেন কেন? আপনারা নিজেদের মতো নিয়ম করছেন নাকি!’’ কেউ আবার মুখের সামনে মোবাইল এনে বলছেন, ‘‘বলুন, টাকা দিতে পারবেন না। আমরা রেকর্ড করে হেড অফিসে পাঠাব!’’ কেউ আবার চেঁচিয়েই বলছেন, ‘‘অফিসের পরে দেখি, কী করে বাড়ি ফেরেন!’’

আমাদের কিন্তু সেই একটাই অস্ত্র, মুখে ঝুলিয়ে রেখেছি হাসি। আর এক মনে কাজ করতে যেতে হচ্ছে। ৯ তারিখ থেকে রোজ সকাল ৯টায় অফিস ঢুকছি। আর বাড়ি ফিরছি রাত ১০টা-সাড়ে ১০টায়। লক্ষ্য একটাই, গ্রাহকদের সুষ্ঠু ভাবে সাহায্য করা। আর চাহিদা একটাই, গ্রাহকরাও যেন আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করেন।

যেমন করলেন এক পূজারী। গত মঙ্গলবার দেখি লাইন ভেঙে তিনি চলে এসেছেন ব্যাঙ্কের ভিতরে। কাউন্টারে নামিয়ে রাখলেন একটি প্যাকেট, ‘‘এটা নিন।’’ চমকে উঠে বললাম, ‘‘এখানে প্যাকেট রাখবেন না। টাকা নিজের কাছে রাখুন।’’ পূজারী বললেন, ‘‘না, টাকা নয়। আপনারা এ ভাবে খাটছেন। মানুষদের অনেকে জল, সরবত দিচ্ছেন। আপনাদের খাওয়ার সময় নেই। দেওয়ার কেউ নেই। তাই আপনাদের জন্য পুজোর মিষ্টি, সন্দেশ এনেছি।’’

ভাল লাগল। এত চাপের মধ্যেও ভাল লাগল

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement