পাইপের চারপাশের আড়াই মিটার বালি চুরি হয়ে গিয়েছে।—সুজিত মাহাতো
বালি মাফিয়াদের দৌরাত্ম্যে রাস্তাঘাট খারাপ হওয়া বা পথ দুর্ঘটনার অভিযোগ তো ছিলই। গরম পড়তেই অন্য একটি সমস্যাও সামনে উঠে এল।
জেলা প্রশাসনের নিষেধকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আকছার বালি তোলার দৌলতে ইতিমধ্যেই টান পড়তে শুরু করেছে পুরুলিয়ার কাশীপুরের জলের ভাঁড়ারে। কাশীপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দারা প্রমাদ গুনতে শুরু করেছেন। জলের জোগান দিতে গিয়ে আক্ষরিক অর্থেই হিমসিম খাচ্ছেন জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দফতরের ইঞ্জিনিয়ারেরা।
কাশীপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের কাশীপুর, কল্লোলি, রঙিলাডি, দৈকিয়ারি, রামবনি, বেলডাঙা, বাথানবাড়ি-সহ বেশ কিছু এলাকায় নলবাহিত পানীয় জল সরবরাহের পরিষেবা রয়েছে। কাশীপুরের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে দ্বারকেশ্বর নদ। তার তীরে সতীঘাট পাম্পিং স্টেশন থেকে জল তুলে বাড়ি বাড়ি সরবরাহ করে জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দফতর। দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, চারটি নলকূপের মাধ্যমে নদীখাত থেকে জল তোলা হয়ে থাকে। রোজ দু’ বেলার চাহিদা মেটাতে প্রায় ১ লক্ষ ৬০ হাজার গ্যালন জল তুলতে হয়।
দফতরের ইঞ্জিনিয়াররা জানান, কিছু দিন আগেও টানাটানি করে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু এখন অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, চারটি নলকূপের কোনওটি থেকেই জল উঠছে না। দফতরের সহকারি ইঞ্জিনিয়ার (রঘুনাথপুর মহকুমা) মিলন ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর অল্প কিছুটা জল জমছে। সারা দিনে ৬০ হাজার গ্যালন জলও পাওয়া যাচ্ছে না।’’ যেটুকু জল উঠছে, তাও এতটাই ঘোলা যে পরিশোধনের পরেও পরিস্কার হচ্ছে না।
এই পাম্পিং স্টেশনে কাজ করে সদ্য অবসর নিয়েছেন এমন কয়েক জন কর্মী জানান, তাঁদের দীর্ঘ কর্মজীবনের অভিজ্ঞতায় এমনটা কখনও দেখেননি। প্রকল্প শুরু হওয়ার পর থেকে এ রকম জলকষ্টে পড়তে হয়নি। অনেক গ্রীষ্ম পার হয়েছে। জল কম উঠেছে। কিন্তু চারটি উৎসের কোনওটি থেকেই জল মিলছে না— এমন ঘটনা বেনজির।
এ দিকে সতীঘাটের থেকে কিছুটা দূরে রয়েছে পলাশকোলা জল প্রকল্পের পাম্পিং স্টেশন। সেখান থেকে জল সরবরাহ হয় আদ্রায় একটি বড় এলাকায়। সতীঘাটের অবস্থায় অশনি সঙ্কেত দেখছেন ওই পাম্পিং স্টেশনের ইঞ্জিনিয়াররাও।
কেন এই সঙ্কট
দফতরের ইঞ্জিনিয়াররা জানান, দারকেশ্বর বর্ষার জলে পুষ্ট নদ। বর্ষার ক’মাস নদে জল থাকে। সেই জল নদী খাতের বালির মধ্যে চুঁইয়ে যায়। ফলে বছরের বাকি সময় যখন নদী শুকনো থাকে, তখনও বালির মধ্যে কিছু জল থেকে যায়। এই জলকে বলা হয় ‘সাব-সার্ফেস ওয়াটার’। বালি থেকে নলকূপের মাধ্যমে সেই জল তুলে পরিশোধন করে সরবরাহ করা হয়।
দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, বালির স্তরে মধ্যেই জল থাকে বলে যে সমস্ত ঘাটে পাম্পিং স্টেশন রয়েছে, সেখানে বালি তোলা নিষিদ্ধ। সতীঘাটের কাছে নদী খাতে কমবেশি ষোলো ফুট বালির স্তর ছিল। কিন্তু লাগামছাড়া ভাবে বালি তোলার দৌলতে সেই স্তর এখন অনেকটাই নেমে গিয়েছে।
সম্প্রতি সতীঘাটে গিয়ে ছবিটা পরিষ্কার বোঝা গেল। চড়া রোদ মাথায় নিয়ে, খটখটে শুকনো নদীর খাতে দাঁড়িয়ে মিলনবাবু একটি পাইপ দেখালেন। ওই পাইপ দিয়ে বালির গভীর থেকে জল তুলে আনা হয়। মিলনবাবু জানান, পাইপটির মাথা কম পক্ষে বালির এক মিটার গভীরে থাকার কথা। কিন্তু লাগামছাড়া বালি চুরির দৌলতে সেটি আপাতত বালির প্রায় দেড় মিটার উপরে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
এই অবস্থায় আর ক’দিন প্রকল্প চালু রাখা যাবে তা নিয়ে ইতিমধ্যেই সংশয় দেখা দিয়েছে দফতরের ইঞ্জিনিয়ারদের মধ্যে। মিলনবাবুর দাবি, অবিলম্বে বালি তোলা বন্ধ না করলে এলাকায় জল সরবরাহ যে কোনও দিন বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে প্রশাসনকে একাধিকবার চিঠি দিয়ে সতর্ক করা হয়েছে। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কতটা হয়েছে, নদী খাতে উঁচিয়ে থাকা নলকূপের পাইপ তার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ।
কী বলছে সেচ দফতর
স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, বালি মাফিয়াদের এহেন দৌরাত্ম্য দেখেও হাত গুটিয়ে বসে রয়েছে প্রশাসন। রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে চুরিয়ে নয়, প্রকাশ্য দিনের আলোয় প্রসাশনের চোখের সামনে দিয়ে চলে এই ঘাট থেকে বালি তোলা। নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে দিনে পর দিন এমন বেপরোয়া ভাবে বালি তোলার ঘটনায় বালি মাফিয়াদের সঙ্গে প্রশাসনের একাংশের যোগসাজশেরও অভিযোগ তুলেছেন তাঁরা।
পুরুলিয়া জেলা সেচ দফতরের সুপারিন্টেন্ডিং ইঞ্জিনিয়ার কৌস্তভজ্যোতি পাল জানান, সতীঘাট থেকে বালি তোলার কোনও ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি দফতর থেকে। কিন্তু তার পরেও কী ভাবে চলছে বালি তোলা? প্রশ্নের জবাব মেলেনি কোনও কর্তার থেকেই। দফতরের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘ব্যাপারটা তো স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনেরই দেখার কথা।’’
তবে সেচ দফতরের একটি সূত্রের দাবি, বালি মাফিয়াদের হাত অনেক দূর অবধি বিস্তৃত। বালি পাচার আটকাতে আধিকারিকেরা দফতর থেকে বেরোতেই সেই খবর আগে ভাগে পৌঁছে যায় পাচারকারীদের কাছে। রাস্তায় যদি কোনও বালি বোঝাই গাড়ি ধরা পড়ে, চালক কোনও একটি ঘাট থেকে বালি তোলার অনুমতিপত্র দেখিয়ে দেয়। কোন ঘাট থেকে বালি তোলা হয়েছে, হাতে নাতে না ধরতে পারা অবধি তা আলাদা করে বোঝার উপায় নেই। সেই সুযোগে দফতরের থেকে কোনও একটি ঘাটের ইজারা নিয়ে, সেই কুমির ছানা দেখিয়ে অন্য অনেক ঘাট থেকে বালি হাওয়া করে চলেছে মাফিয়ারা।
তবে পরিস্থিতি যে দিকে গড়িয়েছে, তাতে পুলিশ এবং প্রশাসনও কিছুটা নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়েছে। সম্প্রতি ঘাটে নজরদারির ব্যবস্থা করেছে প্রশাসন। পুলিশ সূত্রের খবর, অভিযান চালিয়ে কয়েকটি বালি বোঝাই গাড়ি আটকও করা হয়েছে। কিন্তু জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দফতর আগে থেকে সতর্ক করা সত্ত্বেও চোর পালানোর আগে তাঁরা উদ্যোগী হলেন না কেন? জবাব দেননি বিডিও (কাশীপুর) মানসী ভদ্র চক্রবর্তী এবং পুলিশ কর্তারা।
এখন উপায়
জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দফতরের ইঞ্জিনিয়াররা জানান, আপাতত নদীর খাতে অন্য কয়েকটি জায়গায় বালি খুঁড়ে কিছু জলের সন্ধান মিলেছে। কিন্তু সেখান থেকে জল পরিশোধনাগারে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা নেই। ফলে সেই জল পাম্প করে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে নলকূপগুলির গর্তে। সেখান থেকে পরিশোধনাগার হয়ে বাড়ি বাড়ি পৌঁছচ্ছে জল। সঙ্কটের কথা জেনে সম্প্রতি সতীঘাটে গিয়ে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেন কাশীপুর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সৌমেন বেলথরিয়া। মাফিয়া-রাজ রুখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন তিনিও।
এই আশ্বাসে কাজের কাজ হয় কি না, তার দিকেই এখন তাকিয়ে কাশীপুরের বাসিন্দারা।