প্রতীকী ছবি
নজরবন্দি জীবন। আশপাশে থাকা মানুষজন কেউ পরিচিত নন। হাতে কোনও কাজ নেই। আগামী দিনে বেঁচে থাকলেও কাজ টিকে থাকবে, এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। বাড়ি ফিরলে গ্রামের লোক তাঁদের কী ভাবে নেবেন— এমন অনেক প্রশ্নের সামনে পড়লে রাগ, অবসাদ, একাকিত্ব, হতাশায় ভুগতে থাকা স্বাভাবিক।
জেলার কোয়রান্টিন সেন্টারগুলিতে নজরবন্দি মানুষজন যাতে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ হারিয়ে না ফেলেন, তার জন্য নিয়মিত কাউন্সেলিং চলছে। কিন্তু, সব সময় তাতে সাড়া দিচ্ছেন না কোয়রান্টিনে নজরবন্দিদের কয়েক জন। যাঁদের কাঁধে এ কাজের গুরুদায়িত্ব, সেই কাউন্সেলররা নিয়মিত সে কাজ করতে গিয়ে হাঁফিয়ে উঠছেন বা বিচলিত হচ্ছেন বা কখনও সমস্যার উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না। এমন সমস্যা মেটাতে এগিয়ে এল বীরভূম স্বাস্থ্য জেলা। নিজেরা কী ভাবে ভাল থাকবেন এবং উদ্ভুত সমস্যা মিটিয়ে কোয়রান্টিন সেন্টারগুলিতে নজরবন্দি মানুষজনকে মানসিক ভাবে কী ভাবে চাঙ্গা রাখবেন, সেই বিষয়ে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট বা চিকিৎসা মনোবিদকে দিয়ে কাউন্সেলরদের পরামর্শ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
বুধবার দুপুরে সিউড়ি জেলা হাসপাতাল থেকে ‘জুম’ নামক কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করে ভিডিও কনফারেন্সিং-এর মাধ্যমে বীরভূম স্বাস্থ্য জেলার ১১টি ব্লকের দায়িত্বে থাকা কাউন্সেলরদের পরামর্শ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল জেলা স্বাস্থ্য দফতর। পরামর্শদাতা হিসাবে উপস্থিত ছিলেন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট অনিন্দিতা মুখোপাধ্যায়। ছিলেন বীরভূম স্বাস্থ্য জেলার কর্তারা, সিউড়ি হাসপাতালের সুপার শোভন দে, মনোরোগের চিকিৎসক জিষ্ণু ভট্টাচার্য প্রমুখ।
বীরভূম স্বাস্থ্য জেলার সিএমওএইচ হিমাদ্রি আড়ি জানান, কোয়রান্টিন-এ থাকা ব্যক্তিরা যাতে একাকিত্ব অনুভব না করেন, এই পরিস্থিতিতে ভেঙে না পড়েন সেই জন্য কাউন্সেলিং জরুরি। কিন্তু, সেটা যাতে আরও কার্যকর ভাবে করা যায় এবং যাঁরা এই দায়িত্ব রয়েছেন, তাঁদেরও যাতে সমস্যা না হয় সেই জন্যই এমন পদক্ষেপ। একই বক্তব্য হাসপাতাল সুপার শোভন দে-রও।
জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রতিটি ব্লকে দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্বেষা ক্লিনিকের দু’জন করে কাউন্সেলর আছেন। এ ছাড়াও এইচআইভি ও থ্যালাসেমিয়া কাউন্সেলররা রয়েছেন। তাঁদের সকলকে পালা করে প্রতিটি কোয়রান্টিন সেন্টারে গিয়ে নজরবন্দি মানুষজনকে কাউন্সেলিং করাতে হচ্ছে। কোয়রান্টিন সেন্টারগুলিতে নিয়মিত পুলিশ ও প্রশাসনিক নজরদারি রয়েছে। এ ছাড়া ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের চিকিৎসক ও বিপিএইচএনরা থাকছেন ঠিকই। কিন্তু, নজরবন্দিদের কাউন্সেলিং করানোর দায়িত্ব কাউন্সেলরদের কাঁধেই। বীরভূমে স্বাস্থ্য জেলার আওতায় ১১টি কোয়রান্টিন সেন্টারে আছেন ২৮৪ জন। ভিন্ রাজ্য থেকে জেলায় ফিরে পরিবার পরিজন ছেড়ে সম্পূর্ণ অপরিচিতদের মাঝে হঠাৎ বন্দিজীবনে আবদ্ধ হয়ে পড়ায় অনেকেই মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছেন। কেউ কেউ রেগে যাচ্ছেন। বেঁচে থাকলেও জীবিকা কী হবে তা নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় রয়েছেন অনেকে।
কেউ ভাবছেন, বাড়িতে ফিরলে গ্রামের মানুষ তাঁদের কী ভাবে নেবেন। কোনও উপসর্গ না-থাকার পরেও কেন এ ভাবে আটকে থাকতে হচ্ছে, তা জানিয়ে চোটপাট করছেন অনেকে। জিনিসপত্র ভাঙছেন কেউ কেউ। কাউন্সেলিং করেও যা কিছু ক্ষেত্রে আটকানো যাচ্ছিল না। অন্য দিকে, সব সমাল দিতে না পারায় এবং দিনের পর দিন এ কাজ করে যেতে হচ্ছে বলে অবসাদে ভুগতে শুরু করেছিলেন কিছু কাউন্সেলরও। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সেই সব দিকগুলোই আলোচনা করেন। নানা প্রশ্নের উত্তর দেন।
অনিন্দিতার পরামর্শ, ‘‘১৪ দিন খুব বড় সময় নয়। কিন্তু, খারাপ সময় কাটতে চায় না। সেটাকে মুহূর্তে মুহূর্তে হিসেব না করে অন্য দিকে মনোনিবেশ করা উচিত। সেটা লুডো, ক্যারম-এর মতো ইন্ডোর গেম, গানের লড়াই, মোবাইলে গান শোনা হতে পারে। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেও সময় পেরিয়ে যাবে।’’ দ্বিতীয় যে ভয়টা মনের মধ্যে বাসা বেঁধেছে সেটা হল আগামী দিনে জীবিকা কী হবে। মনোবিদ বলছেন, ‘‘তাঁদের বোঝাতে হবে, এই সমস্যা শুধু তাঁদের জীবনে নয়। পৃথিবী জুড়ে বহু মানুষের জীবনে আসতে চলছে। বাঁচলে একটা ব্যবস্থা হবেই। সরকারও চেষ্টা করছে। তাই ভেঙে পড়লে চলবে না। ভাল সময় আসবেই।’’
অনেকেই ভাবছেন বাড়ি ফিরে গ্রামের মানুষ তাঁদের কী ভাবে নেবেন। এখানে ওই গ্রামের মানুষজনকে বোঝানোর উপরে গুরুত্ব দিতে চান মনোবিদ। কারণ, ঠিক জ্ঞানই ভীতি দূর করতে সাহায্য করে। তার পরেও যদি সমস্যা হয় কারও, তা হলে মনোরোগের চিকিৎসককে দেখিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।’’ কাউন্সেলরদের বলা হয়েছে যোগ, মেডিটেশন করে নিজেদের চাঙ্গা রাখতে। কাজটিকে সেবামূলক হিসেবেও দেখতে।