দখল-মুক্ত হল না এডওয়ার্ড হল

হাইকোর্টের নির্দেশ মানেনি প্রশাসন

ঐতিহ্যবাহী এডওয়ার্ড মেমোরিয়াল হলের জায়গায় গড়ে ওঠা বেআইনি নির্মাণ ভাঙার নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। দেড় বছর আগের সেই নির্দেশ জেলা প্রশাসন এখনও কার্যকর না করায় ক্ষোভ ছড়িয়েছে জেলার শিল্পী মহলে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ১১ অগস্ট ২০১৪ ০০:৫১
Share:

সভাঘরের পাশে কো-অর্ডিনেশন কমিটির অফিস ও পুরসভার নির্মাণ নিয়েই বিতর্ক।—নিজস্ব চিত্র।

ঐতিহ্যবাহী এডওয়ার্ড মেমোরিয়াল হলের জায়গায় গড়ে ওঠা বেআইনি নির্মাণ ভাঙার নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। দেড় বছর আগের সেই নির্দেশ জেলা প্রশাসন এখনও কার্যকর না করায় ক্ষোভ ছড়িয়েছে জেলার শিল্পী মহলে।

Advertisement

বাঁকুড়া জেলা গ্রন্থাগারের উত্তরে ও জেলা শাসকের দফতরের ঠিক পাশেই ঝোপঝাড় ও ঝুপড়ি ঘর পরিবেষ্টিত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ব্রিটিশ আমলের এই সভাঘর। ১৯১০ সালে অ্যালবার্ট এডওয়ার্ডের স্মরণে এই সভাঘর তৈরি করা হয়। সেই সময়ে গুণীজন সংবর্ধনা থেকে নানা অনুষ্ঠান এখানেই হত। এই সভাঘর তখন কার্যত বাঁকুড়ার টাউন হল হয়ে উঠেছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারের অভাবে জীর্ণ হয়ে কালের গর্ভে যেতে বসেছিল এডওয়ার্ড হল। কিছু শিল্পীর আন্দোলনে কয়েক বছর আগে সভাঘরের সংস্কার হয়। হলটিকে ‘ঐতিহ্যবাহী ভবন’-এর স্বীকৃতিও দেয় রাজ্য হেরিটেজ কমিশন।

কিন্তু সভাঘর চত্বরে দীর্ঘদিন ধরে ঝুপড়ি করে বাস করা লোকেদের তুলতে পারেনি প্রশাসন। তাঁরা এখন সভাঘরের বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছেন। সাদা রং করা বারান্দায় মধ্যেই উনুন জ্বেলে রান্না করে খাওয়া দাওয়া করছেন। শিল্পীদের দাবি, এতে হেরিটেজ কমিশনের নিয়ম লঙ্ঘন করা হচ্ছে। ভবনটির বর্তমান অবস্থা দেখে অনেকে তাই বিস্ময় প্রকাশ করছেন।

Advertisement

একসময়কার জেলা সংস্কৃতির অন্যতম পীঠস্থান হিসেবে পরিচিত এই প্রাচীন ভবনটিকে তার পুরনো গরিমা ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে শহরের সংস্কৃতি জগতের মানুষজন দীর্ঘ দিন ধরে আন্দোলন চালিয়ে আসছেন। সভাঘরের আশপাশের কিছু জায়গা বেদখল করে বাঁকুড়া পুরসভা কিছু নির্মাণ করে এবং কো-অর্ডিনেশন কমিটির জেলা কার্যালয় তৈরি করে বলে অভিযোগ। হাইকোর্টে এ নিয়ে মামলা চলছে। বেআইনি দখল মুক্ত করে হলের নিজস্ব জায়গায় গড়ে ওঠা বেআইনি নির্মাণ জেলা প্রশাসনকে ভাঙার নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই নির্দেশ এসেছে প্রায় দেড় বছর আগে। তারপরে দ্বারকেশ্বর নদের উপর দিয়ে বহু জল বয়ে গিয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ হয়নি। প্রশাসনের এই ভূমিকায় রীতিমতো ক্ষোভ ছড়িয়েছে জেলার শিল্পী মহলে।

ইতিহাস বলছে, ইন্দিরা গাঁধী, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মতো ব্যক্তিত্ব এই সভাঘরে এসেছেন। রামকিঙ্কর বেইজের চিত্র প্রদর্শনীও হয় এখানেই। জেলা ও জেলার বাইরের বহু গুণীজনের স্মৃতি আঁকড়ে রেখেছে এই সভাঙর। কিন্তু আশির দশক থেকে হলটি সাধারণ মানুষের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৮৫ সালে বাঁকুড়া মৌজায় সাবেক ৮৪৪ দাগে (০.৩৫৫ একর জমিতে) অবস্থিত এডওয়ার্ড হলের দক্ষিণ দিকের ১৯৬০ বর্গ ফুট জমি কো-অর্ডিনেশন কমিটিকে ‘লিজ’ দেয় জেলা প্রশাসন। অন্য দিকে হলের উত্তর দিকের বেশ কিছুটা জমিও বাঁকুড়া পুরসভা দখল করে কিছু নির্মাণ করে বলে অভিযোগ। এডওয়ার্ড হল ফের জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়ার দাবিতে ২০০৬ সাল থেকে আন্দোলন শুরু করেন বাঁকুড়ার সংস্কৃতি প্রেমী মানুষ। ২০০৯ সালে এই হলটিকে ‘ঐতিহ্যবাহী ভবন’-এর স্বীকৃতি দেয় রাজ্য হেরিটেজ কমিশন। পরের বছর ২০১০ সালে হলটিকে সংস্কারের কাজ শুরু করে রাজ্য সরকার।

সংস্কারের পরে পূর্ত দফতরের কন্সট্রাকশন বোর্ড হলে অফিস গড়ার প্রস্তুতি শুরু করে। প্রতিবাদে মুখর হন বাঁকুড়ার সংস্কৃতি মহলের মানুষ। বন্ধ হয়ে যায় অফিস গড়ার কাজ। এই ঘটনার পর ওই বছরই হলের দু’পাশের দখল হয়ে থাকা জমি উদ্ধার করে হলটি ব্যবহার করার উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে সাধারণের জন্য খুলে দেওয়ার দাবিতে হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করে বাঁকুড়া শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সমাজ এবং ওই সংগঠনের সম্পাদক জয়দীপ মুখোপাধ্যায়।

জনস্বার্থ মামলার আবেদনকারীদের পক্ষের আইনজীবী রঘুনাথ চক্রবর্তী দাবি করেছেন, বাঁকুড়ার জেলাশাসক হলফনামা দিয়ে হাইকোর্টকে জানিয়েছেন এডওয়ার্ড মেমোরিয়াল হলের উত্তর ও দক্ষিণদিকের বেশ কিছুটা জমিতে বাঁকুড়া পুরসভা ও কো-অর্ডিনেশন কমিটি অবৈধ নির্মাণ কাজ করেছে। তিনি বলেন, “গত দেড় বছরের মধ্যে হাইকোর্ট একাধিকবার এডওয়ার্ড হলের জমিতে অবৈধ নির্মাণ ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু সেই নির্মাণ ভাঙতে জেলা প্রশাসনের তরফে কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি।”

ওই সভাঘরের জমিতে অবৈধ নির্মাণের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বাঁকুড়া পুরপ্রধান শম্পা দরিপা দাবি করেছেন, “এডওয়ার্ড হলের জায়গায় আমাদের কোনও নির্মাণ নেই।” শম্পাদেবীর মতোই পুরসভার অবৈধ নির্মাণ নেই বলে দাবি করছেন জেলাশাসক বিজয় ভারতীও। তাহলে হাইকোর্টে হলফনামা দিয়ে পুরসভার অবৈধনির্মাণ আছে বলে কেন জানানো হয়েছিল? প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়েছেন জেলাশাসক। তিনি বলেন, “পুরসভার কোনও নির্মাণ ওই সভাঘরের জায়গায় নেই। তবে কো-অর্ডিনেশন কমিটি সভাঘরের কিছুটা জায়গায় অবৈধ নির্মাণ কাজ করেছে।”

আদালতে হলফনামা দিয়ে এডওয়ার্ড হলের জায়গায় পুরসভার বেআইনি নির্মাণের কথা স্বীকার করার পরে জেলাশাসকের এই ধরনের বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আইনজীবী রঘুনাথবাবু। তিনি বলেন, “আদালতে হলফনামা দিয়ে জেলাশাসক জানিয়ে দিয়েছিলেন যে পুরসভা এডওয়ার্ড মেমোরিয়াল হলের উত্তরদিকে অবৈধ নির্মাণ কাজ করেছে। তার পরেও তিনি কীসের ভিত্তিতে এ কথা বলছেন জানি না।” তবে জেলাশাসক বলেছেন, “দ্রুত আদালতের নির্দেশ মেনে কো-অর্ডিনেশন কমিটির অবৈধ নির্মাণ ভেঙে ফেলা হবে।” এ দিকে কো-অর্ডিনেশন কমিটির বাঁকুড়া জেলা প্রাক্তন সম্পাদক তথা বর্তমান জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মুকুল রায় দাবি করেছেন, “জেলা প্রশাসন আমাদের যতটুকু জায়গা লিজ দিয়েছিল, তারমধ্যেই অফিস নির্মাণ করা হয়েছে। এতদিন এ নিয়ে কোনও প্রশ্ন ওঠেনি। এখন কেন উঠছে বুঝতে পারছি না।”

জেলার সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষজন অবশ্য এডওয়ার্ড হল কবে ফের আগের চেহারায় সংস্কৃতির পীঠস্থান হয়ে উঠবে সেটাই দেখতে অধীর। জয়দীপবাবুর দাবি, “হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে দ্রুত জেলা প্রশাসন এডওয়ার্ড হল দখলমুক্ত করুক। আবার টাউনহলের মর্যাদা পেয়ে ওই সভাঘরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হোক। এটাই আমরা চাই।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন