Infiltrators Flee Back

সত্যি কথা বলতে লজ্জা কিসের! আমাদের এখন তাড়িয়ে দিচ্ছে, তাই চলে যাচ্ছি, বলছেন অস্থায়ী ছাউনিতে থাকা হাবিবেরা

একটি মোক্ষম প্রশ্ন করলেই মুখ চাওয়াচাওয়ি শুরু করছেন বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার অপেক্ষায় বিএসএফ চেকপোস্টের বাইরে বসে থাকা জাকিরুল, সুফিয়ারা। সব প্রশ্নের অকপট উত্তর দিচ্ছেন। তবে একটি প্রশ্ন শুনলেই মুখ চাওয়াচাওয়ি। আজ শেষ কিস্তি।

Advertisement

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০২৫ ১০:০২
Share:

নাবালক পিতা দু’মাসের সন্তানকে নিয়ে বাংলাদেশে ফেরার অপেক্ষায়। খুলনা জেলার কয়রা থানা এলাকায় বাড়ি এই হাবিবের। সন্তানের জন্ম হয়েছে ভারতে। —নিজস্ব চিত্র।

জওয়ান হন বা আধিকারিক, কারও নাম জানার উপায় নেই। জংলাছাপ উর্দির ডান দিকের বুকপকেটের ঢাকনির মাথায় থাকার কথা বিএসএফ জওয়ানের নাম। কিন্তু একজনের উর্দিতেও তা নেই। মুখচোখ থমথমে। চেকপোস্ট পেরিয়ে স্থানীয় যানবাহন এবং বাসিন্দাদের যাতায়াত সামলাচ্ছেন কয়েকজন। কয়েকজন টিনের ছাউনির পিছন দিকে জড়ো হয়ে থাকা জটলার সামনে চেয়ার-টেবিল পেতে বসে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ এবং লেখালিখি করছেন। বাকি দু’চারজন সতর্ক নজর রাখছেন চেকপোস্টের সামনে ঘনিয়ে ওঠা অভূতপূর্ব পরিস্থিতির দিকে। কিন্তু কারও বুকে নাম লেখা নেই। নাম লেখা হচ্ছে শুধু অনুপ্রবেশকারীদের। যাঁরা ভিড় জমিয়েছেন সীমান্তে। টিনের ছাউনির পিছনে।

Advertisement

ঘটনাস্থল হাকিমপুর। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের আগে অন্তিম চেকপোস্ট। এ পারে পশ্চিমবাংলার উত্তর ২৪ পরগনা জেলার স্বরূপনগর থানা এলাকা। ও পারে পূর্ববাংলার সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া উপজেলা।

পরিস্থিতি সত‍্যিই অভূতপূর্ব। গরু পাচার, সোনা পাচার, মাদক চোরাচালান, অবৈধ অনুপ্রবেশ, চোরাকারবারিদের মধ‍্যে খুনোখুনি— নানা কারণে বার বার খবরে আসে স্বরূপনগর। সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ার সব রকম লক্ষণ বছরভর ফুটে থাকে ইছামতি আর সোনাইয়ের ঘেরাটোপে বন্দি আদ্যোপান্ত গ্রামীণ জনপদটির শরীরে। কিন্তু যে উপসর্গ গত ১৫ দিন ধরে প্রধান হয়ে উঠেছে, তা স্বরূপনগর আগে কখনও দেখেনি। এই এলাকা ১৯৭১ সালের শরণার্থী স্রোত দেখেছে। শরণার্থীদের খাদ‍্য, বস্ত্র, বাসস্থান সুনিশ্চিতকরণের জন‍্য সরকারি এবং বেসরকারি উদ‍্যোগ দেখেছে। উদ্বাস্তুসেবার কাজে জুড়ে থাকার নামে হাতসাফাই করে সুযোগসন্ধানীদের ফুলেফেঁপে উঠতে দেখেছে। কালক্রমে পূর্ব পাকিস্তানকে ‘বাংলাদেশ’ হয়ে উঠতে দেখেছে। চোরাচালান সাম্রাজ‍্যে একের পর এক মহীরুহের উত্থান-পতন দেখেছে। এলাকার জনবিন‍্যাস ধীরে ধীরে বদলাতে দেখেছে। যা দেখেনি, তা হল অনুপ্রবেশকারীদের এই উল্টো স্রোত। বাংলাদেশে ফেরার জন্য। দিল্লি-সহ বেশ কয়েকটি রাজ‍্যে ধরপাকড় শুরুর পরেই এই স্রোত টের পেতে শুরু করেছিল হাকিমপুর। গত একপক্ষকাল ধরে তা বেড়েছে। শেষ সাত দিনে হাকিমপুর চেকপোস্টের সামনে আক্ষরিক অর্থেই ঢল নেমেছে। অনুপ্রবেশকারীদের ঢল। যাঁরা নিজেরাই ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর দরজায় পৌঁছে বলছেন, ‘‘আমরা অনুপ্রবেশকারী, আমরা অবৈধ ভাবে এসেছিলাম, আমরা বাংলাদেশে ফিরে যেতে চাই।’’

Advertisement

হাকিমপুর চেকপোস্টের ভিতরে ডাকা হয়েছে অনুপ্রবেশকারীদের। বাংলাদেশে পাঠানোর আগে নাম-ঠিকানা নথিবদ্ধ করা চলছে। —নিজস্ব চিত্র।

১০০ মিটার অন্তর একটা করে অস্থায়ী এবং অপরিসর ছাউনি। কোথাও ১০০ জন অপেক্ষায়। কোথাও ১৫০ জন, কোথাও ২০০ জন। আচমকা গুটিয়ে নেওয়া সংসার একাধিক বিশালকায় ব‍্যাগে ভরে রাতারাতি তাঁরা হাজির সীমান্ত চেকপোস্টে। কেউ দু’দিন অপেক্ষায়, কেউ তিন দিন। ভারতের শেষ প্রান্তের দিকে এগিয়ে যাওয়া পিচরাস্তার ধারে ত্রিপল বা পলিথিন বিছিয়ে দিনরাত কাটছে। সাতক্ষীরা জেলার জাকিরুল বা সুফিয়া এসেছিলেন একা। ফিরছেনও একা। আবার খুলনা জেলার হাবিব পরিবারের সঙ্গে নাবালক বয়সে এসেছিল। এখনও আইনত সাবালক নয়। তবে বছর চারেকের অবৈধবাসের মাঝেই এক নাবালিকার সঙ্গে ‘শাদি’ সেরে ফেলেছে। কোলে দু’মাসের সন্তান নিয়ে এখন প্রায় খোলা আকাশের নীচে অপেক্ষায়। তাও এমন এক এলাকায়, যেখানে সন্ধ্যা নামলেই ঝপ করে নেমে যাচ্ছে পারদ।

কোথায় থাকতেন? অধিকাংশেরই উত্তর— নিউটাউন। কেউ সরকারি জমিতে গড়ে ওঠা ঝুপড়িতে। কেউ কোনও খালপাড়ে ঝুলে থাকা বস্তিতে। কেউ সিটি সেন্টার টু-এর পিছন দিকের পাড়ায়। দমদম বা বিরাটি এলাকার বস্তিগুলিতেও কেউ কেউ থাকছিলেন। কেউ তিন বছর, কেউ চার বছর, কেউ আট বছর। বাংলাদেশের কোথায় বাড়ি? জিজ্ঞাসা করলেই প্রত‍্যেকে নিঃসঙ্কোচে নিজের নিজের ঠিকানা বলে দিচ্ছেন। এ দেশে কী করতেন? সুফিয়া বললেন, ‘‘জোগাড়ের (অদক্ষ শ্রমিক) কাজ করতাম।’’ জাকিরুল বললেন, ‘‘ভ‍্যান টানতাম, বিল্ডারের (নির্মাণশিল্প) মাল বইতাম।’’ হাবিব বললেন, ‘‘ময়লার কাজ করতাম। ফ্ল‍্যাটের বাথরুম-টাথরুম সাফ করার কাজ।’’

ভারতে এসে কোনও কার্ড বা পরিচয়পত্র তৈরি করাননি? অধিকাংশের ঝটিতি উত্তর— ‘‘না না, ও সব আমাদের নেই।’’ তবে বিয়ে করে ফেললেও নাবালক হাবিব এখনও সত‍্যিই নাবালক। বলছে, ‘‘মিথ‍্যা কথা বলব না। আধার কার্ড বানিয়েছিলাম। আর একটা প‍্যান কার্ড বানিয়েছিলাম।’’ ভোটার কার্ড হয়নি? হাবিব সলজ্জ হেসে বলে, ‘‘না, ওটা হবে কী করে? ১৮ বছর এখনও হয়নি তো আমার।’’

কেউ দু’দিন ধরে বসে। কেউ তিন দিন। অপেক্ষা সীমান্তের ও পারে যাওয়ার জন‍্য বিএসএফের ডাক আসার। —নিজস্ব চিত্র।

কিন্তু এসআইআর হলে এঁদের সমস‍্যা কোথায়? ভোটার তালিকায় যদি তাঁরা সত‍্যিই নাম না তুলে থাকেন, তা হলে তাঁদের ঠিকানায় তো বিএলও-রা ফর্ম নিয়ে যাবেনই না। সে ক্ষেত্রে এক দিকে এসআইআর হয়ে যেত এসআইআরের মতো। অন‍্য দিকে অনুপ্রবেশকারীরা থেকে যেতেন নিজেদের ঠিকানাতেই। এনআরসি না হওয়া পর্যন্ত কোনও সমস‍্যাই হত না। বরং এ বারের এসআইআর এবং নির্বাচন মিটে যাওয়ার পরে তাঁরা ধীরেসুস্থে ভোটার তালিকায় নাম তোলানোর চেষ্টাও শুরু করে দিতে পারতেন। ভোটার তালিকায় যদি নাম না-ই থাকে, তা হলে আচমকা ফিরে যাওয়ার দরকার পড়ছে কেন? এ প্রশ্নের কোনও সদুত্তর কারও কাছে নেই। কেউ অসহায় ভঙ্গিতে হেসে ফেলছেন। কেউ পাশের জনের মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা নামিয়ে নিচ্ছেন। কেউ কথোপকথনে অনীহা দেখিয়ে ভিড়ের পিছনে চলে যেতে চাইছেন।

কিছু প্রশ্নের জবাব অবশ‍্য বিএসএফের কাছেও নেই। চেকপোস্টে কর্তব‍্যরতদের কেউই আনুষ্ঠানিক ভাবে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে রাজি নন। স্থানীয় কোম্পানি কমান্ডারের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েও লাভ হচ্ছে না। বলা হচ্ছে, ‘‘এখানে কারও সঙ্গে কথা বলে লাভ নেই। কেউ সরকারি ভাবে কিছু বলবেন না। যা বলার ডিআইজি সাহেব বলবেন। দক্ষিণবঙ্গ ফ্রন্টিয়ারের সদর দফতরে চলে যান।’’ অর্থাৎ হাকিমপুর থেকে সোজা নিউটাউন।

বার বার নানা অছিলায় চেকপোস্টের ছাউনিতে ঢুঁ মারার জেরেই হোক বা নাছোড়বান্দার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার ইচ্ছায় এক সাব-ইনস্পেক্টর সামান‍্য মুখ খুললেন পরিচয় না প্রকাশ করার শর্তে। প্রশ্ন ছিল, এই ‘পুশব‍্যাক’ হচ্ছে কোন আইনের বলে? কেউ যদি ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে স্বীকার করে নেন, তিনি অবৈধ পথে ভারতে ঢুকেছেন, তা হলে তো তৎক্ষণাৎ তাঁকে গ্রেফতার করার কথা। পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার কথা। তার পরে আদালত সিদ্ধান্ত নেবে যে, এঁদের জেলে ভরা হবে নাকি বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে। হাকিমপুরে তা তো হচ্ছে না! সাব-ইনস্পেক্টর বললেন, ‘‘আগে যা হয়েছে, সে সব কথা ছেড়ে দিন। এখনকার মতো পরিস্থিতি কি আগে কখনও দেখেছেন? আমাদের এখনকার পরিস্থিতি অনুযায়ী কাজ করতে হচ্ছে।’’

কী ভাবে হচ্ছে সে কাজ? বিএসএফ আধিকারিক জানালেন, যাঁরা চেকপোস্টের সামনে এসে অপেক্ষা করছেন, তাঁদের থেকে রোজ ২০০ জনকে ভাগে ভাগে ডেকে নেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে তাঁদের ঠিকানা কী জেনে নেওয়া হচ্ছে। ছবিও তুলে রাখা হচ্ছে। বক্তব‍্যের ভিডিয়ো রেকর্ডিং করা হচ্ছে। তার পরে চেকপোস্ট থেকে বিএসএফের গাড়িতে তুলে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে সীমান্ত লাগোয়া ক‍্যাম্পে। অনুপ্রবেশকারীদের নামঠিকানা বাংলাদেশের বাহিনী বিজিবি-কে দেওয়া হচ্ছে। তারা নাম-ঠিকানা যাচাই করে নিশ্চিত হওয়ার পরে এঁদের ফেরত নিচ্ছে। কারও নাম-ঠিকানা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেনি বলে তাঁকে বিজিবি ফেরত নেয়নি, এমন ঘটনা কি এখনও পর্যন্ত ঘটেছে। সাব-ইন্সপেক্টর বললেন, ঘটেনি।

পশ্চিমবঙ্গে ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) শুরু হতেই সকলে প্রমাদ গুনেছেন। দলে দলে বাংলাদেশ ফিরছেন। অকপটে সে কথা প্রত‍্যেকে স্বীকারও করছেন। এসআইআর নামক পরিভাষাটি অধিকাংশেরই অজানা। কেউ বলছেন, ‘‘ওই যে, এনআরসি শুরু হয়েছে।’’ কেউ বলছেন, ‘‘এ দেশের সরকার এখন তো আমাদের ফিরে যেতে বলছে।’’ কেউ বলছেন, ‘‘সত‍্যি কথায় লজ্জা কী? আমাদের তো এখন তাড়িয়ে দিচ্ছে। তাই চলে যাচ্ছি।’’

দিন যাচ্ছে আর ভিড় জমছে হাকিমপুরে। (শেষ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement