বৃহস্পতিবার ধনধান্য প্রেক্ষাগৃহে কন্যাশ্রী দিবসের অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: পিটিআই।
আগামী বছর রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। সেই ভোটের বছরে ‘কন্যাশ্রী দিবস’কে আরও ব্যাপক পরিসরে উদ্যাপন করতে চান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ইতিমধ্যে রাজ্যে ৯৩ লক্ষের বেশি ছাত্রী কন্যাশ্রীর সুবিধা পাচ্ছে। আগামী বছরে এই সংখ্যাকে ১ কোটিতে নিয়ে যেতে চান তিনি। মমতা জানান, আগামী বছর ১ কোটির লক্ষ্যমাত্রা স্পর্শ করে গেলে কন্যাশ্রীর জন্য ‘স্পেশাল সেলিব্রেশন’ (বিশেষ উদ্যাপন) হবে।
বৃহস্পতিবার আলিপুরের ধনধান্য প্রেক্ষাগৃহে কন্যাশ্রী দিবসের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। সেখানে কন্যাশ্রী প্রকল্পের পাশাপাশি ছাত্রীদের জীবনের মানোন্নয়নের জন্য সবুজসাথী, তরুণের স্বপ্ন প্রকল্পের কথাও তুলে ধরেন মমতা। সবুজসাথী চালু হওয়ার পর থেকে এখনও পর্যন্ত ১ কোটি ৩৮ লক্ষ ছাত্রছাত্রীকে সাইকেল দিয়েছে রাজ্য সরকার। এর জন্য সরকারের খরচ হয়েছে ৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। সেই পরিসংখ্যান তুলে ধরে মমতা বলেন, “খরচটা যেখান থেকেই হোক জোগাড় করি। সংসার যারা চালায়, তারা খরচাটাও জোগাড় করে অ্যাডজাস্ট করে নেয়।” কন্যাশ্রীতে আগামী বছরের জন্য ১ কোটির লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করে মমতা জানান, এই প্রকল্পের জন্য সরকার ইতিমধ্যে ১৭ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে।
আগামী বছর নির্ধারিত সময় ভোট হলে মে-জুন মাসের মধ্যে নতুন সরকারের শপথগ্রহণ হয়ে যাওয়ার কথা। কন্যাশ্রী দিবস পালিত হয় ১৪ অগস্ট। ফলে মমতা বৃহস্পতিবার যে ‘স্পেশ্যাল সেলিব্রেশন’-এর কথা বলেছেন, তা ভোটের পরে হবে। ফলে লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়ে মমতা ভোটের পরের ‘স্পেশাল সেলিব্রেশন’-এর যে আগাম ঘোষণা করলেন, তা রাজনৈতিক ভাবেও অর্থবহ বলে অভিমত অনেকের। বোঝাতে চাইলেন, ২০২৬ সালে তিনিই ফের ক্ষমতায় ফিরছেন।
এই প্রসঙ্গেই প্রশাসনিক স্তরের অনেকে কয়েক সপ্তাহ আগে বীরভূমে মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক বৈঠকের কথা উল্লেখ করছেন। যে বৈঠকে আবাস প্রকল্পের কথা বলতে গিয়ে মমতা বলেছিলেন, “১২ লক্ষ মানুষকে বাংলার বাড়ির টাকা ইতিমধ্যেই দিয়ে দিয়েছি। আরও ১৬ লক্ষ মানুষ প্রথম কিস্তি পাবেন আগামী ডিসেম্বরে। তার পর যা বাকি থাকবে, তা তিন-চার বছরের মধ্যে করে দেব।’’ অর্থাৎ শুধু কন্যাশ্রীর বিশেষ উদ্যাপন নয়, মমতা ভোট-পরবর্তী সময়ে কী কী করবেন, তা বলতে শুরু করেছেন। অন্তত প্রশাসনিক মহলের অনেকের অভিমত তেমনই।
২০১৩ সাল থেকে রাজ্য সরকার কন্যাশ্রী প্রকল্প শুরু করে। প্রথমে ছিল শুধু স্কুল স্তরের ছাত্রীদের জন্য। পরে কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়কেও এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে কেন কন্যাশ্রী শুরু করা হয়, সেই ভাবনার কথাও ধনধান্য প্রেক্ষাগৃহে তুলে ধরেন মুখ্যমন্ত্রী। মমতা বলেন, “আমি দেখলাম, অনেক বাবা-মা চিন্তা করেন। তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেওয়ার ‘প্রেশার’ দেন বাচ্চাদের উপরে। তারা পড়াশোনা করতে পারে না। সেই জন্য তাদের কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়টাও কভার করা উচিত। আজ কিন্তু সরকারি স্কুলে সবাই কন্যাশ্রী।’’ মমতা আরও বলেন, ‘‘কোনও ভেদাভেদ নেই, ভাগাভাগি নেই। কলেজে তাঁরা কন্যাশ্রী-২ পান, বিশ্ববিদ্যালয়ে কন্যাশ্রী-৩ পান। তার পরেও যাঁরা বাইরে পড়াশোনা করতে চান, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার থেকে নানা রকম কিছু হতে চান, তাঁদের জন্য ১০ লক্ষ টাকার স্মার্ট কার্ড আছে।”
তৃণমূলের প্রচারের ভাষ্যে বার বার ঘুরে ফিরে আসে কন্যাশ্রী প্রকল্পের কথা। শুধু কন্যাশ্রী নয়, লক্ষ্মীর ভান্ডার, স্বাস্থ্যসাথী, সবুজসাথীর মতো প্রকল্পগুলিকে ভোট-প্রচারে তুলে ধরে শাসকদল। ২০২৬ সালের ভোটেও অনেক কিছুর সঙ্গে রাজ্য সরকারের সামাজিক প্রকল্পও যে তৃণমূলের প্রচারের অন্যতম অভিমুখ হবে, এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই।
মুখ্যমন্ত্রী বৃহস্পতিবারের অনুষ্ঠানে ফের তুলে ধরেন স্কুলছুটের সংখ্যা হ্রাসের পরিসংখ্যান। কন্যাশ্রী প্রকল্প চালু হওয়ার আগে মেয়েদের স্কুলছুটের হার এবং এখন মেয়েদের স্কুলছুটের হারের ফারাক তুলে ধরেন তিনি। মমতা জানান, ২০১১-১২ সালে মেয়েদের (প্রাথমিক) স্কুলছুটের হার ছিল প্রায় ৪.৭৫ শতাংশ। এখন তা শূন্য হয়ে গিয়েছে। রাজ্য সরকারের সমালোচকদের উদ্দেশেও জবাব দিতে চেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। মমতা বলেন, “স্বামী বিবেকানন্দ বলতেন নিচু থেকে লোক তুলে আনতে। মেথরের ঘর থেকে, মুচির ঘর থেকে নেতৃত্ব বেরিয়ে আসবে। আজ গর্ব করার নেই? আজ মেয়েরা দেখিয়ে দিয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষায় বাংলায় স্কুলছুটের হার জ়িরো, জ়িরো, জ়িরো।”
এর পরে মুখ্যমন্ত্রী আরও জানান, মাধ্যমিক স্তরে ২০১১-১২ সালে মেয়েদের স্কুলছুটের হার ছিল ১৬.৩২ শতাংশ। ২০২৩-২৪ সালে তা কমে হয়েছে ২.০৯ শতাংশ। উচ্চমাধ্যমিক স্তরে ২০১১-১২ সালে মেয়েদের স্কুলছুটের হার ছিল ১৫.৪১ শতাংশ। এখন তা কমে হয়েছে ৩.১৭ শতাংশ। মমতা বলেন, “তার মানে মেয়েরা পড়াশোনা করছে ভাল করে।”
২০১৩ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার মূলত বাল্যবিবাহ রোখার জন্য এবং অর্থনৈতিক ভাবে অনগ্রসর পরিবারগুলির মেয়েদের লেখাপড়ায় সহায়তা করার জন্য এই প্রকল্প চালু করে। ২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায় সরকারের এই প্রকল্প। ওই বছর রাষ্ট্রপুঞ্জের বিচারে ৬২টি দেশের ৫৫২টি সামাজিক প্রকল্পের মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রকল্প হিসাবে নির্বাচিত হয় কন্যাশ্রী প্রকল্প। মুখ্যমন্ত্রী নিজে নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহরে রাষ্ট্রপুঞ্জ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার গ্রহণ করেছিলেন। বৃহস্পতিবারের বক্তৃতায় সেই দিনের কথাও উল্লেখ করেন মমতা। তিনি বলেন, “সারা পৃথিবীর প্রায় ৬০০ প্রকল্প এসেছিল। তার মধ্যে থেকে প্রথম নাম ঘোষণা হল কন্যাশ্রীর। বিশ্বাস করুন, গর্বে আমার বুকটা ভরে গিয়েছিল সে দিন। আমার এখনও গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।”
বৃহস্পতিবার কন্যাশ্রী দিবসের অনুষ্ঠানে দেশের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিতে বাংলা ভাষা এবং বাঙালি মনীষীদের অবদানের কথাও স্মরণ করান মুখ্যমন্ত্রী। মমতার কথায়, “বাংলা ভাষার যে মাধুর্য আছে, তা কোথাও পাবেন না।” তিনি জানান, প্রয়োজনে ইংরেজি ভাষাও শেখা দরকার। কারণ সেটি একটি আন্তর্জাতিক ভাষা। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “সব ভাষাই জানা উচিত। যত ভাষা শিখবেন, তত উন্নত হবেন। কিন্তু দয়া করে মাতৃভাষাকে ভুলবেন না। মাটিটাকে ভুলবেন না।” তাঁর বক্তৃতায় উঠে আসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজি নজরুল ইসলাম, ক্ষুদিরাম বসু, প্রফুল্ল চাকি, রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, স্বামী বিবেকানন্দ-সহ অন্য বাঙালি মনীষীদের নামও। তিনি জানান, স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় সবচেয়ে বেশি জেলে ছিলেন বাঙালিরাই। সেই ইতিহাস বোঝানোর জন্য মেয়েদের আলিপুর মিউজ়িয়াম ঘুরিয়ে দেখানোরও পরামর্শ দেন মমতা।