(বাঁ দিকে) তৃণমূল নেতা মুকুল রায়। বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় (ডান দিকে)। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
তৃণমূল নেতা মুকুল রায়ের বিধায়কপদ কেন খারিজ করে দেওয়া হল? বেনজির ভাবে কেন বিধানসভার স্পিকারের সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করল আদালত? উভয়েরই ব্যাখ্যা দিয়েছে কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি দেবাংশু বসাক এবং বিচারপতি মহম্মদ শব্বর রশিদির ডিভিশন বেঞ্চ। দলত্যাগ বিরোধী আইন প্রয়োগ করে মুকুলের বিধায়কপদ খারিজ করা হয়েছে। তিনি কৃষ্ণনগর উত্তর কেন্দ্রের বিধায়ক ছিলেন। তাঁর পদ খারিজ হওয়ায় ওই কেন্দ্র ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। তবে নতুন করে সেখানে আর উপনির্বাচন হবে না। কারণ, ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন আসন্ন।
২০২১ সালের নির্বাচনে কৃষ্ণনগর উত্তর থেকে বিজেপির টিকিটে জিতেছিলেন মুকুল। কিন্তু ভোটপর্ব মেটার পরেই ১১ জুন তিনি তৃণমূলে যোগ দেন। তৃণমূল ভবনে গিয়ে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে দলের পতাকা তুলে নিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন মুকুলের পুত্র শুভ্রাংশ রায়ও। কিন্তু মুকুল দলত্যাগ করেও বিধায়কপদ ছাড়েননি। বিজেপি এখানেই আপত্তি করেছিল। বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তবে মুকুলের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করেননি স্পিকার। তাঁর যুক্তি ছিল, মুকুলের দলত্যাগের ১০০ শতাংশ প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তিনি নিজেও দলত্যাগের কথা মানেননি। বরং জানিয়েছেন, ‘সৌজন্যবশত’ তিনি তৃণমূল ভবনে গিয়েছিলেন।
এর পরেই শুভেন্দু হাই কোর্টে মামলা করেন। বিধানসভায় পাবলিক অ্যাকাউন্ট্স কমিটির (পিএসি) চেয়ারম্যান পদটিতে সাধারণত বিরোধী দলের বিধায়ককে নিয়োগ করা হয়। এ ক্ষেত্রে সেই পদ বিজেপি বিধায়ক হিসাবে পেয়েছিলেন তৃণমূলের মুকুল। বিজেপি নেত্রী অম্বিকা রায় এ বিষয়ে পৃথক একটি মামলা করেন। মুকুলের বিধায়কপদ খারিজ করে বৃহস্পতিবার হাই কোর্ট মোট তিনটি যুক্তি দিয়েছে। প্রথমত, দলত্যাগ বিরোধী আইনে মামলা কোনও অপরাধমূলক মামলা নয়। এতে কেউ জেলে যাবেন না বা ফৌজদারি কোনও শাস্তি হবে না। এটি সংবিধানগত বিষয়। তাই এ ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ প্রমাণ প্রয়োজন বলে স্পিকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা সঠিক নয়। দ্বিতীয়ত, মুকুল নিজেই স্বীকার করেছেন যে, তিনি তৃণমূল ভবনে গিয়েছিলেন। সাংবাদিক বৈঠকের কথাও অস্বীকার করেননি। সংবাদমাধ্যমে ওই সংক্রান্ত কোনও খবরের বিরোধিতা করেননি। ফলে যা অস্বীকার করা হয়নি, তা আইন মতে সত্য বলে ধরে নেওয়া যায়। তৃতীয়ত, মুকুলের তৃণমূল ভবনে যাওয়া এবং তৃণমূলে যোগদানের ছবি, ভিডিয়ো এবং স্ক্রিনশট রয়েছে। সেই সমস্ত প্রমাণ উপেক্ষা করা যায় না।
এ ছাড়াও আদালতের পর্যবেক্ষণ, অভিযোগকারী কোনও প্রমাণ দিলে, প্রতিপক্ষ যদি তা অস্বীকার না-করেন, তবে তা স্বীকৃত হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। বিজেপির তরফে মুকুলের বিরুদ্ধে যা প্রমাণ খাড়া করা হয়েছে, মুকুল তা সে ভাবে অস্বীকার করেননি। মুকুলের যুক্তি ছিল, তাঁর স্ত্রী সেই সময় অসুস্থ থাকায় মানসিক ভাবে তিনি চাপে ছিলেন। সৌজন্যবশত তৃণমূল ভবনে গিয়েছিলেন। আনুষ্ঠানিক কোনও যোগদান হয়নি। আদালত সেই যুক্তি খারিজ করে দিয়েছে।
উল্লেখ্য, ভারতীয় সংবিধানের দশম তফসিল অনুযায়ী, কোনও বিধায়ক যদি স্বেচ্ছায় দল পরিবর্তন করেন, তবে তাঁর বিরুদ্ধে দলত্যাগের অভিযোগ আনা যায়। ধারা ২(১)(এ)-তে বলা হয়েছে, শুধু ‘আনুষ্ঠানিক পদত্যাগপত্র’ দিলেই দলত্যাগ হয় না। অনেক ক্ষেত্রে আচরণের মাধ্যমেও প্রমাণিত হয় যে, তিনি দল ছেড়েছেন। যদি অন্য দলের নেতাদের সঙ্গে মঞ্চে গিয়ে যোগ দেন বা তেমন কোনও ঘোষণা করেন, তাও স্বেচ্ছায় দলের সদস্যপদ ত্যাগ হিসাবে ধরে নেওয়া হবে। মুকুল বিজেপিকে আনুষ্ঠানিক ভাবে পদত্যাগপত্র জমা দেননি। তবে তাঁর আচরণে দলত্যাগ প্রমাণিত হয়েছে।
মুকুলের দলত্যাগ প্রমাণিত হলেও বিধায়কপদ খারিজের বিষয়ে আদালত সিদ্ধান্ত নিতে পারে কি? সাধারণত, লোকসভা বা বিধানসভার স্পিকারের সিদ্ধান্তে সাংবিধানিক কোনও আদালত হস্তক্ষেপ করে না। স্পিকারের সিদ্ধান্তে ভুল থাকলে পুনর্বিবেচনার পরামর্শ দিয়ে থাকেন বিচারপতি। ভুল চিহ্নিত করে বিষয়টি আবার স্পিকারের কাছেই পাঠানো হয়। এ ক্ষেত্রে কেন আদালত সিদ্ধান্ত নিল? ডিভিশন বেঞ্চের পর্যবেক্ষণ, গত চার বছর ধরে এই মামলা চলছে। স্পিকার বার বার ভুল করেছেন। আগেও তাঁর কাছে বিষয়টি ফেরত পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু সিদ্ধান্ত তিনি বদলাননি। চলতি বিধানসভার মেয়াদ আর বেশি দিন নেই। এই পরিস্থিতিতে আবার স্পিকারের কাছে বিষয়টি পাঠালে বিচারে দেরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই সমস্ত তথ্যপ্রমাণ খতিয়ে দেখে আদালত মুকুলের বিধায়কপদ খারিজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দুই বিচারপতির বেঞ্চ জানিয়ে দিয়েছে, ২০২১ সালের ১১ জুন দলত্যাগের দিন থেকেই মুকুল বিধায়কপদের অযোগ্য। তাই স্পিকারের সিদ্ধান্ত বাতিল করে মুকুলের এই পদ খারিজ করা হল।
আদালতের রায় প্রসঙ্গে স্পিকার বিমান বলেছেন, ‘‘আমি সব দিন বিবেচনা করেই মুকুল রায়ের বিরুদ্ধে আনা দলত্যাগ বিরোধী আইনের মামলা খারিজ করেছিলাম। মহামান্য আদালত যে নির্দেশ দিয়েছে, তা ভাল ভাবে দেখে আমি পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব।’’ বিধানসভায় স্পিকারের সিদ্ধান্তই সর্বোচ্চ, মনে করিয়ে দিয়েছেন বিমান। বিশদে না দেখে আদালতের রায় নিয়ে কোনও মন্তব্য তিনি করতে চাননি।