Keshpur Rally of Abhishek Banerjee

শনিবার কেশপুরে সভা অভিষেকের, কিন্তু কেন কেশপুরেই? খোঁজ নিল আনন্দবাজার অনলাইন

বাংলার রাজনীতিতে পরিচিত নাম কেশপুর। সেই কেশপুরে শনিবার তাঁর প্রথম সভা করবেন অভিষেক। কিন্তু এ সভা শুধুই সভা করার জন্য নয়। তৃণমূলের জন্য অনেক বার্তার ভূমি হয়ে উঠতে পারে শনিবারের কেশপুর।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৯:০২
Share:

কেশপুরে শনিবার সভা করবেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। — ফাইল চিত্র।

কেশপুর। চাষের মাঠের আলে বন্দুক রেখে যুদ্ধ। এন্তাজ আলি। মহম্মদ রফিক। জামশেদ আলি ভবন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সিপিএমের শেষপুর’ স্লোগান।

Advertisement

পশ্চিম মেদিনীপুরের রাজনীতির কথা উঠলে এক সঙ্গে উচ্চারিত হয় এই নাম ও শব্দবন্ধগুলি। সেই কেশপুরে শনিবার যাচ্ছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূল তথা মমতার রাজনৈতিক উত্থানের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এককালের ‘যুদ্ধক্ষেত্র’ কেশপুরে সভা করবেন অভিষেক। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক গত এক বছরে বাছাই কিছু এলাকায় সভা করেছেন। সেই বাছাইয়ে ষষ্ঠ স্থানে কেন কেশপুর? কারণ একটি নয়, অনেকগুলি।

১৯৯৮ সালে জন্ম হয়েছিল তৃণমূলের। তার পর থেকেই অবিভক্ত মেদিনীপুরের জনপদ কেশপুরে সিপিএমের বিরুদ্ধে সম্মুখসমরে যেতে হয়েছিল বাংলার বর্তমান শাসকদলকে। দু’দলের মধ্যে সংঘর্ষ চলেছিল কয়েক বছর ধরে। সেই সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়েছিল পাঁশকুড়া উপনির্বাচন কেন্দ্র করে। তখন ঘাটাল নয়, পাঁশকুড়া ছিল লোকসভা আসন। সেই আসনেই উপনির্বাচনে অধুনাপ্রয়াত বামনেতা গুরুদাস দাশগুপ্তকে হারিয়ে দেন তৃণমূলের আনকোরা প্রার্থী বিক্রম সরকার। এর পরেই পাঁশকুড়ার অন্তর্গত কেশপুর বিধানসভা এলাকার হারানো গ্রামাঞ্চল দখলে ঝাঁপিয়ে পড়ে বামেরা। সেই শুরু। দেশি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে সিপিএম-তৃণমূলের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ প্রায় নিয়মিত হয়ে যায়। এক সময়ে এই কেশপুর নিয়েই মমতা স্লোগান তুলেছিলেন, ‘কেশপুর, সিপিএমের শেষপুর’।

Advertisement

তৃণমূল তথা মমতার রাজনৈতিক উত্থানের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এককালের ‘যুদ্ধক্ষেত্র’ কেশপুরে সভা করবেন অভিষেক।

এখন সেই দিন আর নেই। কিন্তু কেশপুর যেন কেশপুরেই রয়েছে। পালাবদলে কেশপুর তৃণমূলের হাতে এলেও ছায়া হয়ে থেকেছে সংঘর্ষ। কখনও কখনও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বও রক্তক্ষয়ী, প্রাণঘাতী হয়েছে। গত নভেম্বরেই দুই গোষ্ঠীর মারামারিতে হাত উড়ে গিয়েছিল তৃণমূল কর্মী রফিক আলির। স্থানীয় বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী শিউলি সাহাও থামাতে পারেননি গোষ্ঠীসংঘাত। পশ্চিম মেদিনীপুরের তৃণমূল নেতারাই বলছেন, ২০১১ সালে রাজ্যে পালাবদলের পরে ১২ বছরে মোট সাত বার ব্লক সভাপতি পরিবর্তন করতে হয়েছে।

এমনই এক গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে দীর্ণ এলাকায় যাচ্ছেন অভিষেক। দলের কাছে যা ঐতিহাসিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং সাংগঠনিক ভাবে খানিক উদ্বেগের কারণ। তৃণমূলের কেউ কেউ বলেন, গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ছায়া পড়েছে ভোটের রাজনীতিতেও। এক সময়ে রেকর্ড ভোটে সিপিএম জিতত কেশপুরে। ২০১১ সালে এই আসন অবশ্য তৎকালীন জোটসঙ্গী কংগ্রেসকে ছেড়েছিল তৃণমূল। রজনীকান্ত দলুই হেরেছিলেন ৩৩,৮৫১ ভোটে। ২০১৬ সালে সেই কেশপুরেই একলা লড়ে তৃণমূল জেতে ১ লাখ ১ হাজার ১৫১ ভোটে। নন্দীগ্রামের মেয়ে শিউলি বিধায়ক হন কেশপুর থেকে। বিজেপি পেয়েছিল ৯ হাজার ৭৩ ভোট।

কিন্তু কংসাবতী দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গিয়েছে। ২০২১ সালেও জিতেছেন শিউলি। কিন্তু ব্যবধান কমে হয়েছে ২০ হাজার ৭২০ ভোট। আর বিজেপির ভোট বেড়ে হয়েছে ৯৬ হাজার ২৭২। এমনটা যে হতে পারে, তা বোঝা যায়নি ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলেও। অঙ্ক বলছে, ঘাটাল লোকসভা আসনে তৃণমূলের ‘মুখরক্ষা’ করেছিল কেশপুরই। সাংসদ দীপক অধিকারী (দেব) জিতেছিলেন ১ লাখ ৭ হাজার ৯৭৩ ভোটে। এর মধ্যে কেশপুর থেকেই ব্যবধান ছিল ৯২ হাজার ৭৪ ভোট।

২০১৯ সালেও তৃণমূলের কাছে ‘লক্ষ্মী’ কেশপুর ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে ‘কঠিন ঠাঁই’ হয়ে ওঠে। কোথায় ৯২ হাজার আর কোথায় ২০ হাজার! ব্যবধান কমে গিয়েছিল প্রায় ৭২ হাজারের। যা তৃণমূলের কাছে ‘অশনি সংকেত’ বলেই মনে করেন দলের নেতাদের একটা বড় অংশ।

সেই কারণেই অভিষেক তাঁর সভার জন্য বেছে নিয়েছেন কেশপুরকে। দুই মেদিনীপুর মিলিয়ে গত এক বছরে এটি তাঁর তৃতীয় সভা। হলদিয়া, কাঁথির পরে কেশপুর। আগের দু’টি সভা থেকে ‘সাংগঠনিক বার্তা’ যেমন দিয়েছেন অভিষেক, তেমনই বলেছেন ‘সাংগঠনিক সংস্কার’-এর কথাও। জেলা তৃণমূলের নেতাদের অনুমান, এই সভায় মূলত সংগঠনের কথাই শোনা যাবে অভিষেকের মুখে। কারণ, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বন্ধ করার পাশাপাশি তিনি চাইছেন শক্তিশালী হোক সংগঠন। যার জন্য সকলের আগে দরকার ঐক্য। তাই জেলা থেকে ব্লকের নেতারা খানিক চিন্তাতেও রয়েছেন!

সংগঠন মজবুত করার প্রয়োজন আছে। লোকসভা নির্বাচন দূরে নয়। ঘাটাল আসন ধরে রাখতে হবে তৃণমূলকে। ঘাটাল জয়ের জন্য ‘তারকা’ দেবকে পাঠিয়েছিলেন মমতা। ২০১৪ সালে জয় এসেছিল ১ লাখ ৩৬ হাজার ৯০৯ ভোটে। তৃণমূলের অন্দরে কান পাতলে শোনা যায়, দ্বিতীয় বার দেব প্রার্থী হতে চাননি। তবে শেষমেশ মমতার কথা ফেলতে পারেননি। জিতলেও ব্যবধান কমেছিল প্রায় ৩০ হাজার। ‘শেষরক্ষা’ করেছিল কেশপুর। কিন্তু আগামী লোকসভা নির্বাচনে যে তিনি আর প্রার্থী হতে চান না, সেটা প্রকাশ্যেও বলেছেন দেব। তাঁর সেই ইচ্ছা বজায় থাকলে তৃণমূলকে নতুন প্রার্থী খুঁজতে হবে। কিন্তু ‘নায়ক’ দেবের কাজ অন্য যে কাউকে দিয়ে হয়ে যাবে, তা হলফ করে বলা যায় না। যদি না পর্যাপ্ত আগাম প্রস্তুতি এবং শক্তিশালী সংগঠন থাকে।

২০১৯ সালের ভোটে ধাক্কা খাওয়ার পর থেকেই ২০২৪ সালের লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছিলেন তৃণমূলের নেতারা। ২০২১ সালের বিপুল জয়ের পর সেই লক্ষ্য আরও জোরদার করেছেন অভিষেক। সেই লক্ষ্যে কেশপুর তাঁর কাছে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ বইকি।

কেশপুর কেন যাচ্ছেন অভিষেক? উত্তর— ২০২৪ সালের প্রস্তুতির সলতে পাকাতে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন