বিপদ যে ওষুধের টিনেই ঘাপটি মেরে আছে, তা কে জানত!
ওষুধ মানে কীটনাশক। নিজের সওয়া দুই একর জমি জুড়ে থাকা চা-গাছে পোকা ধরলেই জলে মিশিয়ে ওই ওষুধ দেদার ছড়িয়ে দিতেন সৌমেন ঘোষ। কিন্তু মাসখানেক আগে পানবাড়িতে আসা একটি সংস্থার বিশেষজ্ঞেরা জানিয়ে দিলেন, দুনিয়া জুড়ে ওই ওষুধ নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই। কারণ, ওই কীটনাশক এতটাই ক্ষতিকর যে, শরীরে ঢুকে মহিলাদের গর্ভের সন্তানকেও পঙ্গু করে দিতে পারে।
সাতভেন্ডি গ্রামের কৌশিক রায় নিজের ১০ একর জমিতে প্রতিটি চা-গাছের জন্য সার দিয়েছেন ২০০ গ্রাম। ওই বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকেই তিনি জানলেন, গাছ-পিছু ৮০ গ্রাম সারই যথেষ্ট ছিল। পাঁচ একর জমিতে চা চাষ করতে গিয়ে এত দিন অকারণে অতিরিক্ত সেচ দিয়েছেন, জানালেন ঝাড়বড়গিলা গ্রামের হরিশ্চন্দ্র রায়।
সৌমেন, কৌশিক, হরিশ্চন্দ্র এঁরা সকলেই জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ি ব্লকে রামসাই গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার পানবাড়িতে তৈরি হওয়া ক্ষুদ্র চা উৎপাদকদের স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্য। বর্তমানে ওই গোষ্ঠীর সদস্য-সংখ্যা ৩৪০। গোষ্ঠীটি এখন ২৭৯ হেক্টর জমিতে বছরে ৩৫ লক্ষ কিলোগ্রামেরও বেশি কাঁচা চা-পাতা উৎপাদন করছে। লাভের টাকা এবং টি বোর্ডের আর্থিক সহায়তায় ২০১২ সালে চায়ের কারখানাও চালু করে দিয়েছে ওই স্বনির্ভর গোষ্ঠী।
চ্যাংমারির পরমেশ্বর রায়, পানবাড়ির আনন্দ মণ্ডলদের কথায়, “এত দিন চা চাষ করেছি অনেক কিছু না-জেনে, না-বুঝে। এই প্রথম আমাদের বিজ্ঞানভিত্তিক চা চাষের পাঠ দেওয়া শুরু হল।” টি বোর্ডের তত্ত্বাবধানে তাঁদের এই বিজ্ঞাননির্ভর প্রশিক্ষণ দিচ্ছে ‘সলিডারিডাড’ নামে নেদারল্যান্ডসের একটি সংস্থা।
সলিডারিডাড এখন পানবাড়ির ওই ক্ষুদ্র চা-চাষিদের প্রত্যেকের কাছ থেকে তাঁদের জমি ও গড় ফলনের পরিমাণ, সেচের জলের উৎস ও পদ্ধতি, কীটনাশক ও সারের প্রয়োগ প্রভৃতি সম্পর্কে সবিস্তার তথ্য সংগ্রহ করছে। সেই তথ্যের ভিত্তিতে বেছে নেওয়া হবে ১০ জন চাষিকে। তাঁরা নিজেরা ডাচ সংস্থাটির বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ পাবেন। পরে তাঁরাই আবার পরিবেশ-বান্ধব ও উন্নত মানের চা উৎপাদনের প্রশিক্ষণ দেবেন অন্য চাষিদের।
ক্ষুদ্র চাষিরা তো দীর্ঘ কাল ধরে চা উৎপাদন করে আসছেন। এত দিনে তাঁদের এই ধরনের প্রশিক্ষণ কেন?
টি বোর্ডের ‘ক্ষুদ্র চা চাষি উন্নয়ন অধিকার’-এর মুখ্য উপদেষ্টা গণপতি বোরিয়া বলেন, “দেশে মোট উৎপাদিত চায়ের ৩৩ শতাংশ ক্ষুদ্র চাষিদের কাছ থেকে এলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেই চায়ের মান ভাল নয়।” তাঁর বক্তব্য, ওই মান উন্নত করার জন্যই পানবাড়িতে পাইলট প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণের জন্য পানবাড়িকে বেছে নেওয়ার কারণ কী? “দেশের মধ্যে পানবাড়িতেই প্রথম ক্ষুদ্র চা-চাষিদের স্বনির্ভর গোষ্ঠীর কারখানা তৈরি হয়েছে। বছরে সাড়ে সাত লক্ষ কেজি চা তৈরি হচ্ছে সেখানে,” বললেন কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান স্মল টি গ্রোয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন (সিস্টা)-এর সভাপতি বিজয়গোপাল চক্রবর্তী। গত বছর পানবাড়ির ওই গোষ্ঠী এক কোটি টাকা লাভ করেছে।
টি বোর্ড সূত্রের খবর, চা চাষের ব্যাপারে নানা পদ্ধতি রূপায়ণে ডাচ সংস্থাটি আগে থেকেই টি বোর্ডকে সহায়তা করছে। সংস্থার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ম্যানেজিং ডিরেক্টর শতদ্রু চট্টোপাধ্যায় জানান, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ পাওয়ার পরে পানবাড়ির ক্ষুদ্র চা-চাষিরা জলের অপচয় রোধ করে এ বছরই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চা চাষ শুরু করবেন।
ক্ষুদ্র চা উৎপাদকদের বক্তব্য, রাতারাতি সব বদলাবে না। বাদল দেবনাথ, সৌমেন ঘোষেরা বলেন, “নিষিদ্ধ কীটনাশক ব্যবহার করব না ঠিকই। কিন্তু তার সরবরাহ ও বিক্রি যাতে নিষিদ্ধ হয়, সেটাও নিশ্চিত করা দরকার। আমাদের চা যে রফতানি হবে, সেই নিশ্চয়তাও প্রয়োজন।”