এত দিন তাঁদের আন্দোলন ছিল অফিসের বাইরে, রাস্তায়। এ বার স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি)-এর অফিসের ভিতরে ঢুকে আন্দোলনে বসে পড়লেন এক দল শিক্ষক-পদ প্রার্থী।
গত বছর দু’দফায় অবস্থান-অনশন-আন্দোলন করেছেন তাঁরা। কোনও ফল হয়নি। চাকরির দাবিতে তাই এ বার সল্টলেকে এসএসসি-র দফতরে ঢুকে সরাসরি চেয়ারম্যানের ঘরের সামনে অনশনে বসলেন ২৫ জন প্রার্থী। মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৪টে নাগাদ প্রায় ১০০ জন চাকরি প্রার্থী স্লোগান দিতে দিতে ১৪৪ ধারা ভেঙে এসএসসি ভবনের ভিতরে ঢোকেন। তার পরে বসেন অনশনে। আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, শিক্ষক নিয়োগের জন্য এসএসসি ২০১২ সালে যে-পরীক্ষা নিয়েছিল, তার মেধা-তালিকায় তাঁদের পরে নাম থাকা অনেক প্রার্থীই চাকরি পেয়ে গিয়েছেন। কিন্তু তাঁরা এখনও নিয়োগের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। চাকরি না-পাওয়া পর্যন্ত তাঁদের অনশন-আন্দোলন চলবে বলে জানিয়ে দিয়েছেন ওই প্রার্থীরা।
তবে কোনও যোগ্য প্রার্থীকে বঞ্চিত করার অভিযোগ মানতে চাননি এসএসসি-র চেয়ারম্যান সুবীরেশ ভট্টাচার্য। তিনি জানান, নিয়মবিধি মেনেই সব কাজ হয়েছে। মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত কমিশনে নিজের অফিসে থাকেন সুবীরেশবাবু। আর শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “আগেই সহানুভূতির সঙ্গে ওঁদের দাবিদাওয়ার কথা শুনেছি। কিন্তু এসএসসি-র নিয়ম মেনে যে কিছু করা সম্ভব নয়, তা জানিয়েছি। এখন ওঁরা সরকারি অফিসে ঢুকে আন্দোলন করছেন। এটা একেবারেই উচিত নয়।”
মেধা-তালিকায় নাম আছে। তবু ওঁদের জন্য কিছু করা সম্ভব নয় কেন?
এসএসসি সূত্রের খবর, কমিশন মারফত সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলের জন্য শিক্ষক-শিক্ষিকা বাছাইয়ের নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে। অঞ্চল, বিষয়, লিঙ্গ, শ্রেণি (সংরক্ষিত বা অসংরক্ষিত) ইত্যাদির ভিত্তিতে শিক্ষক-শিক্ষিকা বাছাই করা হয়। এসএসসি-র দাবি, মেধা-তালিকায় আন্দোলনকারীদের পিছনে থাকা প্রার্থীরা বিভাজন মেনেই চাকরি পেয়েছেন। তবে ২০১২ সালের পরীক্ষার মেধা-তালিকায় অঞ্চল, বিষয়, লিঙ্গ ইত্যাদি বিভাজন ছিল না। সে-বার ‘কম্বাইন্ড’ বা যৌথ মেধা-তালিকা প্রকাশ করেছিল কমিশন।
ওই পরীক্ষা ও ফলপ্রকাশের সময় এসএসসি-র চেয়ারম্যান ছিলেন চিত্তরঞ্জন মণ্ডল। তিনি এ দিন জানান, হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চ একটি রায়ে বলেছিল, সংরক্ষিত শ্রেণির প্রার্থী ‘র্যাঙ্ক’ পেলে তাঁর চাকরির সম্ভাব্য সব সুযোগ দেখাতে হবে মেধা-তালিকায়। অর্থাৎ সংরক্ষিত ও অসরংক্ষিত, দু’টি ক্ষেত্রেই তিনি কী কী সুযোগ পেতে পারেন, তা দেখাতে হবে। এই রায় ডিভিশন বেঞ্চ এবং সুপ্রিম কোর্টেও মান্যতা পায়। “তাই যৌথ তালিকা প্রকাশ করা ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। অন্যথায় আইনি জটিলতার আশঙ্কা ছিল,” বলছেন চিত্তবাবু।
নিয়ম অনুযায়ী মেধা-তালিকায় প্রতিটি শূন্য পদের জন্য দেড় জন প্রার্থীর নাম প্রকাশ করে কমিশন। অর্থাৎ ১০০টি শূন্য পদের জন্য ১৫০ জনের নাম থাকে মেধা-তালিকায়। তাই তালিকাভুক্ত সব প্রার্থীরই চাকরি পাওয়ার কথা নয়। সে-দিক থেকেও আন্দোলনকারীদের দাবির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেকে।
কিন্তু আন্দোলনকারীরা এই সব যুক্তি মানতে রাজি নন। তাঁদের তরফে ইন্দ্রাণী বাগচীর অভিযোগ, “রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্টে জানিয়েছে, তারা ৩৫ হাজার প্রার্থীকে চাকরি দিয়েছে। কিন্তু এ-পর্যন্ত ২৮ হাজার প্রার্থী চাকরি পেয়েছেন। সরকারের এই মিথ্যাচার কেন? কেনই বা আমরা চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত?” স্কুলশিক্ষা দফতরের এক কর্তা বলেন, “আন্দোলনকারীরা কী বলেছেন, তা জানি না। তবে কোথাও কোনও রকম ভুল তথ্য দেওয়া হয়নি।”
২০১২-র এসএসসি পরীক্ষার মেধা-তালিকা প্রকাশিত হয় ২০১৩-র সেপ্টেম্বরে। আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, মেধা-তালিকায় তাঁদের পরে নাম থাকা অনেক প্রার্থী চাকরি পেয়ে গিয়েছেন। কিন্তু তাঁরা কাউন্সেলিংয়েই ডাক পাননি। তাই চাকরির দাবিতে গত বছর থেকেই তাঁরা আন্দোলন চালাচ্ছেন। ২০১৪-র ফেব্রুয়ারিতে এসএসসি-র দফতরের সামনের রাস্তায় টানা প্রায় তিন সপ্তাহ অবস্থান করেন চাকরি না-পাওয়া প্রার্থীরা। তাঁদের অনেকে অবশ্য পরে কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে চাকরি পেয়েছেন। কিন্তু অনেক প্রার্থী এখনও সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত বলে আন্দোলনকারীদের অভিযোগ।
আন্দোলনকারী এক প্রার্থী গত বছরের মাঝামাঝি ‘আত্মহত্যা’ করেন। আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, চাকরি না-পেয়েই ওই প্রার্থী চরম পথ বেছে নেন। গত ২৫ জুলাই থেকে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অনেক প্রার্থী কলেজ স্কোয়ারে মঞ্চ বেঁধে অবস্থান করেন। পরে তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতার আশ্বাসে অবস্থান ওঠে। হামেশাই মিছিল এবং ধর্মতলায় অবস্থান করেন আন্দোলনকারীরা। এমনকী চাকরির দাবিতে রক্ত দিয়ে লেখা চিঠিও পাঠান মুখ্যমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রীদের কাছে। রাজ্যপাল, কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী-সহ অনেকের সঙ্গেই দেখা করে চাকরির দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। এ দিন তাই চাকরির দাবিতে ফের আন্দোলন শুরু করেছেন ওই প্রার্থীদের অনেকে।