ইরানের তিন পরমাণুকেন্দ্র ফোরডো, নাতান্জ় এবং ইসফাহান। ছবি: সংগৃহীত।
ফোরডো, ইসফাহান এবং নাতান্জ়— ইরানের এই তিন পরমাণুঘাঁটি লক্ষ্য করে রবিবার ভোরে (ভারতীয় সময়) হামলা চালিয়েছে আমেরিকা। ট্রাম্প সমাজমাধ্যমে দাবি করেছেন, আমেরিকার এই হামলা অত্যন্ত সফল হয়েছে। এমন হামলা চালানোর ক্ষমতা বিশ্বের আরও কোনও দেশের নেই। তিনি এ-ও লিখেছিলেন, ‘‘ফোরডো শেষ।’’ কিন্তু ইরানের তরফে এ কথা স্বীকার করা হয়নি। বরং ইরানের ন্যাশনাল নিউক্লিয়ার সেফ্টি সিস্টেম সেন্টারকে উদ্ধৃত করে সে দেশের সরকারি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, কোনও পরমাণুকেন্দ্র থেকেই কোনও তেজস্ক্রিয় বিকিরণ হচ্ছে না। ফলে ওই সমস্ত পরমাণুকেন্দ্রের আশপাশের জনগণ সম্পূর্ণ সুরক্ষিত। চিন্তার কোনও কারণ নেই। সৌদি আরবের পরমাণু কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণকারী সংস্থাও তেজস্ক্রিয় বিকিরণ না হওয়ার কথা নিশ্চিত করেছে।
ইরানে হামলার পর ট্রাম্প হোয়াইট হাউস থেকে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে গিয়ে জানিয়েছেন, ইরানে আরও হামলা হতে পারে। হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আরও অনেক জায়গা রয়েছে। এখনই শান্তিস্থাপন না করা হলে আগামী দিনে আরও বড়, আরও প্রাণঘাতী হামলা হবে।’’ ট্রাম্প এ-ও জানান, ইরানের এই তিন ঘাঁটিতে হামলাই সবচেয়ে কঠিন ছিল। বাকিগুলিতে হামলা আরও সহজ হতে চলেছে। শুক্রবার থেকে ইরানের সঙ্গে ইজ়রায়েলের যে সংঘাত শুরু, রবিবার তাতে প্রথম যোগ দিল আমেরিকা। কিন্তু ইরানে প্রথম হামলার জন্য কেন ফরডো, ইসফাহান আর নাতান্জ়কেই বেছে নিলেন ট্রাম্প? কী আছে এই তিন পরমাণুকেন্দ্রের ভিতরে?
ফোরডো পরমাণুকেন্দ্র
ইরানের রাজধানী তেহরান থেকে ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে একটি পাহাড়ের নীচে রয়েছে ফোরডো পরমাণু গবেষণাকেন্দ্র। এটি ইরানের সবচেয়ে গোপনীয়, সবচেয়ে সুরক্ষিত পরমাণুকেন্দ্র। পাহাড়ের নীচে মাটি থেকে প্রায় ৩০০ ফুট গভীরে এই কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে, যাতে বাইরের কোনও শত্রু আক্রমণ করলে এই কেন্দ্রের গায়ে তার আঁচ না লাগে। যুদ্ধবিমান থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র কিংবা বোমাও ফোরডোর তেমন ক্ষতি করতে পারে না। ইজ়রায়েল থেকে ফোরডো লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছিল। কিন্তু লাভ হয়নি। আমেরিকা দাবি করেছে, ফোরডো ধ্বংস করার ক্ষমতা ইজ়রায়েলের নেই। একমাত্র আমেরিকার কাছেই সেই অস্ত্র রয়েছে। পরমাণু বোমার জন্য প্রয়োজনীয় ইউরেনিয়াম বিশুদ্ধকরণের কাজ চলে ফোরডোতে। দীর্ঘ দিন এই পরমাণুকেন্দ্রের অস্তিত্ব সন্তর্পণে লুকিয়ে রেখেছিল ইরান। পাহাড়ের নীচে গোপনে কাজ চলত। ২০০৯ সালে পশ্চিমি গোয়েন্দা সংস্থাগুলি এই কেন্দ্রের অস্তিত্ব প্রথম টের পায়। তার পর ইরানও সরকারি ভাবে এর অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয়। ফোরডো ঘাঁটি ভূমি থেকে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দ্বারা বিশেষ ভাবে সুরক্ষিত। অনবরত বোমাবর্ষণেও যাতে এই কেন্দ্রের গায়ে আঁচ না-লাগে, তা নিশ্চিত করতে এখানে রাশিয়ার এস-৩০০ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহার করা হয়েছে।
ফোরডো থেকে ৬০ শতাংশ বিশুদ্ধ ইউরেনিয়াম উৎপন্ন হয়। প্রতি মাসে ১৬৬ কেজি করে এই ধরনের ইউরেনিয়াম উৎপন্ন করে ফোরডো। সেই কারণেই এই কেন্দ্রটি ইজ়রায়েল এবং পশ্চিমি শক্তিগুলির মাথাব্যথার অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছে। আমেরিকা রবিবার ফোরডোয় বি২ বোম্বার ব্যবহার করে বাঙ্কার বাস্টার বোমা ছুড়েছে বলে সূত্রের দাবি। এই ধরনের অস্ত্র মাটির নীচে ২০০ ফুট গভীর পর্যন্ত ঢুকে ক্ষয়ক্ষতি করতে পারে।
নাতান্জ় পরমাণুকেন্দ্র
নাতান্জ় পরমাণুকেন্দ্রকে ইরানের ‘ইউরেনিয়াম বিশুদ্ধকরণের মুকুট’ বলা হয়। তেহরান থেকে এটি ২২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে ইরানের কেন্দ্রীয় মালভূমিতে অবস্থিত এই ঘাঁটির একটি বড় অংশ মাটির নীচে রয়েছে। বাকি অংশ রয়েছে মাটির উপরে। এই কেন্দ্রেও ইউরেনিয়াম ৬০ শতাংশ পরিশুদ্ধ করা যায়। এতে সামান্য তেজস্ক্রিয় স্তরে পৌঁছোয় ইউরেনিয়াম, কিন্তু পরমাণু বোমা তৈরির জন্য তা যথেষ্ট নয়। নাতান্জ়ের যে অংশ মাটির উপরে রয়েছে, ইজ়রায়েলের হামলায় সেখানে বেশ কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি।
ইসফাহান পরমাণুকেন্দ্র
১৯৮৪ সালে চিনের সাহায্যে ইসফাহান কেন্দ্রটি তৈরি করেছিল ইরান। এটি তাদের বৃহত্তম পরমাণু গবেষণাকেন্দ্র। ইসফাহান বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সেই গবেষণাকেন্দ্র রয়েছে। তেহরান থেকে এটি ৩৫০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। তিন হাজারের বেশি পরমাণুবিজ্ঞানী এই কেন্দ্রে গবেষণার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এ ছাড়া এখানে রয়েছে তিনটি চিনা গবেষণা চুল্লি এবং পরীক্ষাগার, যা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত।