শিকাগোর দুর্গাপুজো
১৯৭০ সাল। তখনও আনুষ্ঠানিক ভাবে বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন অফ গ্রেটার শিকাগো (বিএজিসি) প্রতিষ্ঠিত হয়নি। হয়েছিল তার ছ'বছর পর, ১৯৭৬ সালের শেষ দিকে। তবে শিকাগোর বুকে বাঙালির সেরা উৎসব দুর্গাপুজো কিন্তু শুরু হয়ে গিয়েছিল ১৯৭০ থেকেই। সেই হিসেবে এ বছর সেই উৎসব পা দিল ৫৫তম বর্ষে। তবে এ বারের উৎসবের মেজাজ ভিন্ন, আনন্দের রং অন্য রকম। জৌলুসে অন্য ধারার মাত্রা। আসলে মন ভাল নেই কারওরই। ভাল থাকার কথাও নয়। কলকাতার আরজি কর হাসপাতালে ঘটে যাওয়া ন্যক্কারজনক ঘটনার ধাক্কায় আমাদের মন অশান্ত।
তবে থমকে থেমে যাওয়ার বান্দা নই আমরা। বিষাদের ছায়া চিরে বেরিয়ে এসেছে আমাদের প্রতিবাদী সুর। তীব্র তার তেজ। সেই তেজী সুরে মা দুর্গার মণ্ডপসজ্জাও তাই অন্য রকম এ বার। সুমিত রায়ের সৃষ্টিতে, পরতে পরতে তার প্রতিফলন। প্রতিমার দু'দিকে দুই বাহুস্তম্ভে সোচ্চার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ৮ অগস্টের ভয়াল রাত। অনুষ্ঠানের অডিটোরিয়ামেও একই প্রতিধ্বনি। অনুষ্ঠান শুরুর আগে নীরবতা পালনে জোরদার হল প্রতিবাদের ভাষা। কলকাতা থেকে অনুষ্ঠান করতে এসেছিলেন অঞ্জন দত্ত। তিনিও বললেন, এ সময়টা বড্ড অন্য রকম। অভয়ার বিচারের দাবিতে সবাই এখন একজোট। এক স্বর। বিএজিসির নিজস্ব উপস্থাপনা 'নারী শক্তি' অভয়াকে নিয়েই। কঠিন সময়ে নারীর উমা হয়ে ওঠার প্রতিবেদন।
শিকাগোয় দুর্গাপুজো মানেই ঠান্ডার মধ্যে মা দুর্গাকে বরণ করে নিয়ে আসতে হয়। কিন্তু এ বার সবটাই অন্য তারে বাঁধা। প্রতিবাদের তীব্রতায় ঠান্ডার তীব্রতা প্রায় বিলীন। টেবিলের ওপর স্তূপাকার জ্যাকেটের পাহাড় তৈরি হয়নি। 'মল অফ ইন্ডিয়া'-তে পুজো। দু'পা হেঁটে পাশের দরজায় 'দ্য ম্যাট্রিক্স ক্লাব'-এ খাওয়াদাওয়া ও সাংস্কৃতিক অনষ্ঠান। এমন ব্যবস্থা এই প্রথম।
আমাদের এখানে সপ্তাহান্তে শুক্র থেকে রবি- আড়াই দিনের পুজো। আচার অনুষ্ঠান হয়েছে নিয়ম মেনে। তাতে কোথাও কোনও খামতি নেই। পুরোহিত রামানুজ ভট্টাচার্য, সঙ্গে খুঁটিনাটি বৃত্তান্তে সহায়ক সুব্রত মুখোপাধ্যায়। সুব্রতদার এই নিখুঁত অবদান গত ৫৫ বছর ধরেই। খামতি হওয়ার জো হবে কী ভাবে! পুষ্পাঞ্জলির মন্ত্রে পুজো প্রাঙ্গণে মিশে যাচ্ছে আমাদের আকুতি। ভেসে উঠছে আমাদের সকলের ইচ্ছে। ভাল রেখো মা। সুস্থ রেখো।
নমঃ মহিষগ্নি মহামায়ে চামুণ্ডে মুণ্ডমালিনী
আয়ুরারোগ্য বিজয়ং দেহি দেবী নমোস্তুতে
'মল অফ ইন্ডিয়া'-য় অনুরণিত হচ্ছে মন্ত্রোচ্চারণের পূণ্যধ্বনি। ঢাক, ঘণ্টা, কাঁসরের শব্দে মা মহেশ্বরীর ত্রিশূলে বাড়ছে শান। অসুর বধ তো হবেই। হতেই হবে। আমাদের প্রার্থনা বিফলে যাবে না। যেতে পারে না।
শুক্রবারের রাত্রি শেষ হোল দোহার দিয়ে। শনিবারের সন্ধ্যায় একগুচ্ছ অনুষ্ঠান। শুরু হয়েছিল শর্ট ফিল্ম 'দ্য পারফেক্ট মার্ডার' দিয়ে। কেউই এখানে পেশাদার পরিচালক, চিত্রনাট্যকার বা অভিনেতা নয়। সবাই আমাদেরই শিকাগোর বন্ধুবান্ধব। কিন্তু তাঁদের এই প্রযোজনায় পেশাদারিত্বের ছাপ সুস্পষ্ট। দর্শকদের হাততালি ও অভিবাদনে অডিটরিয়াম ভরে ওঠে। নজর কেড়েছে বিএজিসি-র খুদে শিল্পীদের নাটিকা 'সাধকের উপাখ্যান'। আধ্যাত্মিকতার প্রেক্ষাপটে ভারতবর্ষের সভ্যতা ও সংস্কৃতির যোগসূত্র বর্তমান পরিস্থিতিতে যে কতটা প্রয়োজনীয়, সেটাই তুলে ধরা হয়েছে তাতে।
রবিবার ছোটদের নাটক 'হযবরল'-তে এ বার বড়রা। শেষটা হয়তো আলাদা, কিন্তু কী অদ্ভুত সমাপতন! বিচার হয় আসামি বাদে, বিচারের বাণী নীরবে কাঁদে। একই ভাবনা নিরন্তর, প্রতিবাদী একই স্বর। সব শেষে লগ্নজিতার লাইভ অনুষ্ঠান।
রবিবার মণ্ডপে পুজো, অঞ্জলি, আরতি ছাড়াও দুপুরবেলায় সিঁদুরখেলা ও ধুনুচি নাচ। বিএজিসির গণ্ডি পেরিয়ে সিঁদুরখেলার প্রাঙ্গণ এবার জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। দেবী দুর্গাকে বরণ করার অধিকার তো সবার। সাহসী পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে। এই মিলনমেলা সবার জন্য।
এত লোকের জন্য এত নিখুঁত আয়োজন, পরিকল্পনা মাফিক পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে আড়াই দিন ধরে লাগাতার তা বাস্তবায়িত করা- সে কাজ মোটেই সহজ নয়। এই অসাধ্য সাধনের জন্য বিএজিসি ২০২৪-এর সভাপতি সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায় ও তাঁর কার্যনির্বাহী সমিতিকে ধন্যবাদ ও কুর্নিশ। ওই যে বললাম, এ বার সবার মন প্রতি বারের দুর্গাপুজোর মতো নয়। এ বারের উৎসব অন্য ধারার। অন্য বার্তা পৌঁছে দেওয়ার উৎসব। মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশের দিকে তুলে ধ্বনিত হচ্ছে- বিচার চাই। সেই একই আকাশ, যেখানে শিকাগো আর কলকাতা মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। হে ঐন্দ্রি - তুমি জাগো। হে দক্ষকন্যা - তুমিই ভরসা। রাত্রিবেলা বাড়ি ফেরার জন্য 'দ্য ম্যাট্রিক্স ক্লাব' থেকে বেরিয়ে পার্কিং লটে যাচ্ছি। বাতাসে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে -
জাগো দুর্গা, জাগো দশপ্রহরণধারিণী
অভয়াশক্তি বলপ্রদায়িনী তুমি জাগো
জাগো, তুমি জাগো...
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy