মিউনিখে বাঙালিদের দুর্গাপুজো।
পুজো যত দেরিতেই হোক না কেন, মা যে আসছেন তা বোঝা যায় রথযাত্রায় খুঁটিপুজোর হিড়িকে । তার কয়েক সপ্তাহপর সোশ্যালমিডিয়া-স্যাভি টলি প্রযোজক-নির্দেশকরা ট্রেলর লঞ্চের মাতামাতি লাফালাফিতে পুজো প্রায় কান ধরে টেনে আনেন শরতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে। উমাকে আর আগমনী দিয়ে আহ্বান করতে হয় না, কোক স্টুডিয়োর দৌলতে সারা বছর এখন “ওই গিরি নন্দিনি”। আর, মহালয়া শেষ হতে না হতেই সদ্য আঁকা চোখ মেলে মাকে তাকাতে হয় ভেজা রঙ নিয়েও — কারণ সেলিব্রিটি সেইদিনই দুপুর দুপুর হাজির ফিতে কাটতে ।
পাঁচটা টাইমজোন দূরের প্রবাসী এসবই জানে, এই ইউরোপে । তবে ইউরোপ মূল ভূখণ্ডের চিত্র কিঞ্চিৎ আলাদা। দেশের পুজোর আড়ম্বর নেই, বিলেতের স্পন্সরবদান্যতার আধিক্য কিংবা মার্কিন মুলুকের উইকেন্ড নমো নমো নেই –ইউরোপের প্রতিটি পুজো নিষ্ঠা ভরে মাকে চারদিন রাখেন একদম রীতিনীতি মেনে । গত বছর মূলভূখণ্ডের প্রায় বত্রিশটি বড় পূজো নিরীক্ষণ করে বলতে পারি, অস্লো থেকে ডেন হাগ, কোলন হয়ে প্রাগ, ওয়ারশ —ইউরোপ প্রবাসী বাঙালি এ বছরও তাঁর ঘোড়ায় আগমনের অপেক্ষায় তৈরি হচ্ছে ।
কৈলাস থেকে মানস সরোবর হয়ে দেবী যদি মর্তে আসেন, প্রবাসীর একটা কৈলাস অবশ্যই তবে আল্পসের ইয়ুগসস্পিতজ (২৯৬২ মিটার উঁচু) । অস্ট্রিয়া সীমান্ত বরাবর জার্মানির সর্বোচ্চ শৃঙ্গ থেকে দেবী আসেন আইবসি’র পাশ দিয়ে । এই লেকটিকে মানস সরোবরের ভ্রাতৃপ্রতিম ভাবা যেতে পারে । তার পর গারমিশ-পারটেঙ্কিরশেন থেকে অটোবান ধরে মায়ের সদবলে মিউনিখ প্রবেশ ।
আরও পড়ুন: পুজো আসছে, বলে দেয় বেগুনি জাকারান্ডার দল
আরও পড়ুন: বাঙালিদের ভোগের খিচুড়ি সাহেবদেরও বড় প্রিয়
“কল্পনাটা মন্দ নয়,” হাসতে হাসতে বললেন মিউনিখের বাঙালি সম্প্রদায়ের সম্পাদিকা সাগরিকা সেন। “মাতৃমন্দির এমন রাজপ্রাসাদে দেবীর আরাধনা করে, সেখানে মায়ের আত্মা যে আছেন সে বিষয় আমি নিশ্চিত।” সিঙ্গাপুরে ছিলেন। কয়েকবছর আগে মিউনিখে এসে হাল ধরেছেন “সম্প্রীতি”র, যাদের পৃষ্ঠপোষক খোদ নেতাজিকন্যা অনিতা পাফ।
মাতৃমন্দির পুজোর কর্ণধার প্রদ্যোৎ তালুকদার যেখানে পুজো করেন সেটি মিউনিখের বিশেষ দ্রষ্টব্য এক রাজপ্রাসাদ। যার স্থানীয় নাম - শ্লস নিম্ফেনবুর্গ। এই প্রাসাদেই জন্ম ইতিহাসপ্রসিদ্ধ রাজা দ্বিতীয় ল্যুডউইগের, যার অসামান্য স্থাপত্যকীর্তির নিদর্শন রয়েছে আল্পসেরই পাদদেশের আনাচেকানাচে । মুঘল সাম্রাজ্যে আকবরের পঞ্চাশ বছরের পৃষ্ঠপোষকতায় যে স্থাপত্য সৃষ্টি হয়েছিল, উনিশ বছরের শাসনে দ্বিতীয় ল্যুডউইগ সেই গতিকে পাল্লা দিতে পারেন । কয়েক বছর আগে নতুন সপ্তম আশ্চর্যের আসরে উঠেছিল খামখেয়ালি রাজার এই অনবদ্য সৃষ্টি নয়শোয়ান্সটাইনের নাম । ওয়াল্ট ডিজনিরও লোগো নাকি এই কেল্লার অনুপ্রেরণায় তৈরি , ভিড় জমানো মার্কিন টুরিস্টদের এমনটাই বিশ্বাস । পনেরো দিনের ঝটিকা সফরে আসা বাসভর্তি বাঙালি পর্যটকেরা কিন্তু এসব টের পান না। কারণ কলকাতার পর্যটন সংস্থাগুলি বুড়ি ছুঁয়ে ফিরতি ফ্লাইট ধরায়, জার্মানির ওই কৈলাসের দিকে যাওয়ার সময় কোথায় ? সেই কারণে এই বিশ্ববরেণ্য স্থাপত্যগুলি এখনও বাঙালির কিঞ্চিত অধরা । মাতৃমন্দিরের পুজোয় এলে তাই অ-মিউনিখবাসীর রথদেখা আর কলাবেচা দুটোই হয় ।
সম্প্রীতির আরেক সদস্য মুনমুন গুহ প্রায় ১২ বছর আছেন এদেশে । মিউনিখের পুজোর ইতিহাস পাওয়া গেল তাঁর থেকেও। মিউনিখের প্রথম পুজো হয় ২০০৮ সালে শহরের হরি ওম মন্দিরে। সেখান থেকে বর্ধিত হতে হতে আজ তিন তিনটে পুজো হয়, লন্ডন বাদে ইউরোপের কোন এক শহরে বোধহয় এতগুলো পুজো হয় না । “গত চার বছরে এখানে হইহই করে বঙ্গসন্তানদের ভিড় বেড়েছে, জার্মানি হঠাৎ খুব আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে উঠেছে; তাই এতগুলো পুজো হওয়াতে পরিক্রমাটা মন্দ হয় না । “সম্প্রীতি” বাঙালিদের সর্ববৃহৎ সংগঠন, এর তরফ থেকে আমরা সবাইকে সাধ্যমত সহযোগিতা করি।”, বললেন মুনমুন । প্রদ্যুতরা নীম্ফেনবুরগে ২০১৫ থেকে পুজো করছেন । স্থান, কাল, কলা, সংস্কৃতি এবং খ্যাতি প্রতিপত্তিতে মাতৃমন্দিরের পরিচালনার সুনাম উত্তরোত্তর বেড়েছে । কৌলিন্যের বিচারে নিম্ফেনবুর্গ যেন শোভাবাজার রাজবাড়ির খানিকটা বিদেশি রূপান্তর । তবে দক্ষিণ জার্মানিতে আরও পুজো হয় – স্টুটগার্টে গঙ্গোপাধ্যায়রা প্রায় কুড়ি বছরের ওপর পুজো করছেন, কাছাকাছি একটি মফস্সলে নৃপেন রায় পরিচালনা করেন বিন্দি’র দুর্গাপুজো। এ ছাড়া এরলাংগানের কতিপয় বাঙালিও নতুন পুজো শুরু করেছেন গত দু’বছর । সব মিলিয়ে শারদ মরসুম ইউরোপে জমজমাট।
ছবি: পুজো উদ্যোক্তাদের সৌজন্যে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy