চতুর্থীর বাধ্যতামূলক পোস্ট– ‘পরশু তো ষষ্ঠী, আপনার কাজ পরশুর মধ্যে শেষ হয়ে যাবে?’ বাঙালির টাইমলাইনে টাইমলাইনে ঘুরছে মিম। তাতে মূলত দু’টি চরিত্র, ফেলুদা এবং গণেশ মহল্লার শশীবাবু। যিনি কাশীর ঘোষালবাড়ির ঠাকুর গড়েন।
আরও পড়ুন:
বাঙালি লেখক, চিত্রপরিচালকদের সৃষ্টিতে বার বার উঠে এসেছে দুর্গোৎসব। কিন্তু দুর্গাপুজোর আবহে জনপ্রিয়তার নিরিখে শীর্ষে থাকবে ফেলুদা ও শশীবাবুর এই কথোপকথন। সত্যজিৎ রায়ের ছবি ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’। পুজোর সময়ে কাশী বেড়াতে গিয়ে ঘোষালবাড়ির গণেশ চুরির কিনারা করতে নেমে পড়েন ফেলুদা। ঘোষালবাড়িতে দুর্গাপুজো হয়। বাড়ির ঠাকুরদালানে প্রতিমা গড়েন শশীবাবু। তদন্তের স্বার্থে সে বাড়িতে পা পড়ে ফেলুদার।
ঠাকুরদালানে তখন মাতৃমূর্তি রং করছিলেন শশীবাবু।
ফেলুদা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘পরশু তো ষষ্ঠী, আপনার কাজ পরশুর মধ্যে শেষ হয়ে যাবে?’ শশীবাবুর জবাব, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তা হয়ে যাবে।’
পুজোর পাটিগণিত অনুসারে এই কথাবার্তা চলছে চতুর্থীর দিন। ফি বছর চতুর্থীতে তাই সমাজমাধ্যমের জুড়ে এই দৃশ্যের ছবি, ভিডিয়োর দেখা মেলে। মিমের বন্যা বয়ে যায়। যাঁর উত্তরে বাঙালির ষষ্ঠী আসে, সেই গণেশ মহল্লার শশীবাবুকে কি চেনে আজকের প্রজন্ম?
শশীবাবুর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সন্তোষ সিংহ। কিংবদন্তি মঞ্চ অভিনেতা। শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। ‘কৃষ্ণসুদামা’ নাটক থেকে ছবি হয়েছিল ‘কৃষ্ণসখা’। ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯২৭ সালে, পরিচালক ছিলেন অহীন্দ্র চৌধুরী। সেটিই ছিল সন্তোষ সিংহের প্রথম বড়পর্দায় অভিনয়। সুদামার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি।
‘সাবিত্রী’, ‘নিমাই সন্ন্যাসী’, ‘বাংলার মেয়ে’, ‘মানে না মানা’, ‘বিদ্যাসাগর’, ‘বৈকুন্ঠের উইল’, ‘পৃথিবী আমারে চায়’, ‘জিঘাংসা’, ‘অভয়ের বিয়ে’-র মতো ছবি রয়েছে সন্তোষের ঝুলিতে। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যবিভাগে প্রায় ১২ বছর (১৯৫৩-১৯৬৬) পড়িয়েছেন। থিয়েটারের দুনিয়ায় ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। ব্যাঙ্কে চাকরি করতে করতে ১৯২৫ সালের অগস্ট মাসে থিয়েটারের জগতে পা রেখেছিলেন সন্তোষ। ‘কর্ণার্জুন’ নাটকে ধৃষ্টদ্যুম্নের চরিত্রে তাঁর আত্মপ্রকাশ। নরেশ সেনগুপ্তের ‘ঋষির প্রেম’ নাটকে প্রথম কেন্দ্রীয় চরিত্র পান। অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ছাত্র সন্তোষ ‘আরোগ্য নিকেতন’, ‘আলিবাবা’, ‘ইরাণের রানী’, ‘রাজসিংহ’, ‘চিরকুমার সভা’র মতো নাটকে মঞ্চে দাপুটে অভিনয় করেছেন। স্টার, মিনার্ভা, রংমহলে কাজ করেছেন। নিজেও দু’টি নাটকের দল খুলেছিলেন, যদিও তেমন সাফল্যের মুখ দেখেনি তারা। ১৯৬৫ সালে বিশ্বরূপায় শেষ বারের মতো মঞ্চে ওঠেন সন্তোষ।
আরও পড়ুন:
সন্তোষ সিংহের কাছে বাংলার সিনেমা জগৎ আরও একটি কারণে কৃতজ্ঞ। উত্তমকুমারের অভিনয় জীবনে গুরুর ভূমিকা পালন করেছিলেন এই মানুষটি। প্রায় ছাপান্ন রকমের ফেসিয়াল এক্সপ্রেশান এবং অসাধারণ ভয়েস মডিলিউশনের ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন তিনি। সে সব শিষ্যকে শিখিয়েও ছিলেন। ‘উল্টোরথ’ পত্রিকায় রবি বসুকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে স্বয়ং উত্তমই বলেছিলেন গুরুর কথা, আত্মজীবনীতেও উল্লেখ করেছিলেন। হাতে ধরে শিষ্যকে মুখের অভিব্যক্তি শিখিয়েছিলেন সন্তোষ। তবে অরুণ তখনও উত্তমকুমার হয়ে ওঠেননি। এমপি পিকচার্স-এ থাকাকালীন তিনি সন্তোষ সিংহকে পেয়েছিলেন শিক্ষক হিসেবে। সেই সন্তোষই আজ নিউজ ফিডে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বছর বছর। তাঁর অভিনীত কালোত্তীর্ণ দৃশ্য ছড়িয়ে দিচ্ছে পুজোর আমেজ।
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।