চার দিক আলোর রোশনাইয়ে সেজে উঠেছে। নতুন জামা পরে শুরু হয়ে গিয়েছে ঠাকুর দেখা। পাড়ায় পাড়ায় বাজছে গান, বসেছে চপ-রোলের দোকান। কল্লোলিনী তিলোত্তমা তার সেরা সাজে সেজে উঠেছে বছরের এই বিশেষ সময়ে। কিন্তু এত আলো, এত আনন্দের মাঝেও কি আপনি নিঃসঙ্গতায় ভুগছেন? একা লাগছে? পুজোর এই দিনগুলিতে কী করে একাকীত্ব, মন খারাপ দূর করবেন, তার হদিস দিলেন মনোচিকিৎসকরা।
কেন হয় এই একাকীত্ব? পুজোর সময়ে কেন তা আরও বেশি করে জাঁকিয়ে বসে? মনোসমাজকর্মী মোহিত রণদীপ আনন্দবাজার ডট কমকে বলেন, “অনেকে পুজোর সময়ে কাছের কোনও মানুষ না থাকার কারণে একাকীত্বে ভোগেন। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় বা যাঁকে কাছের মনে করেন, তাঁরা না থাকলে একাকীত্বে ভোগেন। আবার এই জাঁকজমক, আয়োজন অনেকেরই পছন্দ হয় না। আদর্শগত কারণে পছন্দ হয় না, মনে করেন এই বিপুল আয়োজনের প্রয়োজন নেই। তাঁরা একা হয়ে যান, একা বোধ করেন এই সময়ে। তাই বিচ্ছিন্ন বোধ করেন খানিকটা, কারণ বাকিরা উৎসবে মেতে থাকেন।” প্রায় একই সুর শোনা গেল মনোবিদ শ্রীময়ী তরফদারের গলায়। তিনি বলেন, “আমরা যদি মানুষের সঙ্গে কথা বলতে ভুলে যাই, তবে আমরা তো একা হয়ে পড়বই। তাই না? সর্ব ক্ষণ ফোনের সঙ্গেই সময় কাটাচ্ছি আমরা।”
তবে সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলর পূর্বাশা মুখোপাধ্যায়ের মতে, “একাকীত্ব এক দিনে, একটা উৎসবে হঠাৎ করে আসে না। উৎসব মনের একাকীত্বের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় কেবল। একাকীত্ব এক দিনে জমে না।”
কারণ যা-ই হোক, পুজোর এই আলো ঝলমলে দিনগুলিতে কী ভাবে এর মোকাবিলা করা যাবে? মোহিতের পরামর্শ, “এই একাকীত্ব থেকে বেরোনোর উপায় প্রত্যেকের ক্ষেত্রে একই হবে, এমনটা নয়। যার যা ভাল লাগার জায়গা, সেগুলিকে এক্সপ্লোর করতে হবে। কেউ যদি গল্পের বই পড়তে পছন্দ করেন, তিনি বই পড়তে উদ্যোগী হতে পারেন এই সময়টায়। অনেকে পূজাবার্ষিকী কেনেন। অনেকেই সিনেমা দেখতে পছন্দ করেন, তাঁরা সিনেমা দেখতে পারেন। ছবি আঁকতে পারেন।” তিনি এ-ও বুদ্ধি দেন যে, একাকীত্বে ভোগা মানুষেরা সমমনস্ক বন্ধু বা আত্মীয়দের সঙ্গে এই সময়ে যোগাযোগ তৈরি করতে পারেন, আড্ডা দিতে পারেন। মোহিতের কথায়, “ফোনের মাধ্যমে তো এখন যোগাযোগ করাই যায়। এমনকী, চাইলে ভিডিয়ো কলের মাধ্যমে আড্ডা হতেই পারে। ছোটখাটো কোনও ট্রিপে যেতে পারেন। যদিও বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তুতি অনেক আগে থেকে নিতে হয়। তবে কাছেপিঠে কোনও গ্রাম বা পুরনো শহর, স্থাপত্য দেখে আসতে বা কোথাও যেতে পারেন, প্রকৃতির কাছাকাছি সময় কাটাতে পারেন। এ বার কোনটা কে বেছে নেবেন, তা নির্ভর করে তাঁদের চাহিদা, মানসিকতার উপরে।”
পূর্বাশার মতে, নিজেকে খুঁজে নেওয়া, নিজেকে ভালবাসা অভ্যাস করতে হবে অনেক দিন ধরে। তবেই এই একাকীত্ব সামলানো যাবে। তাঁর কথায়, “অন্য সম্পর্কগুলোকে যত্ন করতে করতে, হাজার কাজের চাপেও নিজের মনের কথা মনে রাখতে হবে। নিজেকে ভালবাসতে শিখতে হবে।” শ্রীময়ীর কথায়, “যে বন্ধুরা আছে, তারা বাইরে থাকে। ঠাকুর দেখতে যাওয়ার সময়ে লোক পাচ্ছেন না? তা হলে কী করণীয়? মানুষের সঙ্গে আরও একটু মিশতে হবে। যাদের সঙ্গে আসা যাওয়া করেন, ক্যাব-বাস-মেট্রোয় যাদের সঙ্গে রোজ দেখা হয়, তাদের সঙ্গে গল্প করতে হবে, বন্ধুত্ব করতে হবে। স্কুল-কলেজের যে বন্ধুদের সঙ্গে তেমন যোগাযোগ নেই, তাদের সঙ্গে নতুন করে যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে। সহকর্মীদের সঙ্গে আরও বন্ধুত্ব জমাতে হবে।”
মোহিত জানান, একাকীত্ব আসলে একটা অনুভূতি। কেউ যদি মনে করে যে তার পাশে কেউ নেই, তখন এই অনুভূতি তীব্র হয়, বিষন্নতায় মন ভরে ওঠে। এটা একটা অসুখ। তাঁর কথায়, “যদি দেখা যায় যে মন ভাল নেই, কোনও কিছু করতে ইচ্ছে করছে না, অন্য সময়ে যা ভাল লাগে সেটাও করতে ইচ্ছে করছে না, কোনও কিছুতে আনন্দ পাচ্ছি না, একা লাগছে, মন খারাপের মাত্রা তীব্র– তখন কোনও মনোচিকিৎসক বা মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের সাহায্য নেওয়া দরকার। কারণ এ ক্ষেত্রে হতে পারে কোনও ওষুধ বা মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তার প্রয়োজন আছে।”
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।