আরাধ্য ঈশ্বরকে গান গেয়ে শোনানো আবহমান কালের রীতি। যুগে যুগে ঈশ্বর সাধনার মাধ্যম হয়ে উঠেছে গান, পদ। সাধকেরা পদ সৃষ্টি করে ঈশ্বর সাধনা করতেন। গান গেয়ে, কাব্য লিখে ঈশ্বরকে খুঁজতে চেষ্টা করতেন। ঈশ্বরের কাহিনি, মাহাত্ম্য প্রচারের জন্যই ভজন, পদাবলী কীর্তনের মতো শক্তিশালী সঙ্গীত ঘরানাগুলির সৃষ্টি। কালীর আরাধনাতেও মিশে আছে গান, কালীর গান। যা ‘শ্যামাসঙ্গীত’ নামে পরিচিত। রামপ্রসাদ, গদাধর চট্টোপাধ্যায়রা দেবী কালিকাকে গান শুনিয়েছেন। গানে গানে কথা বলেছেন দেবীর সঙ্গে, মান-অভিমান করেছেন। সহজ, সরল সে সব গানের মাধ্যমে শ্মশানবাসিনী কালী হয়ে উঠেছেন ঘরের মেয়ে।
আরও পড়ুন:
বহুত্ববাদের পুণ্যভূমি বাংলা। বাংলার অনন্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সাক্ষী ‘শ্যামাসঙ্গীত’। ‘কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন’, ‘আমার শ্যামা মায়ের কোলে চড়ে জপি আমি শ্যামের নাম।/ মা হলেন মোর মন্ত্রগুরু, ঠাকুর হলেন রাধাশ্যাম’, ‘বল রে জবা বল কোন সাধনায় পেলি শ্যামা মায়ের চরণতল’-এর মতো ‘শ্যামাসঙ্গীত’ রচনা করে গিয়েছেন নজরুল ইসলাম। বীরভূমের সতীপীঠ ফুল্লরায় বসে সৃষ্টি করেছেন ‘শ্মশানে জাগিছে শ্যামা মা’-র মতো গান।
অবিভক্ত বাংলার এবং দেশভাগের পর দ্বিখণ্ডিত বাংলার বহু মুসলমান কবি কালীর গান রচনা করেছেন। মুনসি বেলায়েত হোসেন, নওয়াজিস খান, আকবর আলি, সৈয়দ জাফর খাঁ, হাসন রাজা মির্জা হুসেন আলিদের নাম এসে পড়ে। ‘ওমা কালী! কালী গো! এতনি ভঙ্গিমা জান। কত রঙ্গ ঢঙ্গ কর যা ইচ্ছা হয় মন।’, ‘আমি তোমার কি ধার ধারি,/ শ্যামা মায়ের খাসতালুকে বসত করি।’, ‘কালী কহে এই সত্য, সকলই দেখ অনিত্য,/ চিন্তা কর পরমার্থ ছেদন হবে ভববন্ধন।’-এর মতো কালীভক্তির রসে সিক্ত গানগুলি রচনা করেছেন বাংলার মুসলমান কবিরা। সুফি সাধকদের মধ্যেও কালী-প্রভাব ছিল। ইটাওয়াতে সৈয়দ বাবার মাজারে কালীর গান গাওয়া হত।
মুসলিম গায়ক মহম্মদ কাসেম শ্যামাসঙ্গীত গাইতেন। তিনি প্রায় নজরুলের সমসাময়িক। কলকাতায় ভাড়া থাকতেন, বাড়ির মালিকদের নাম ধার করে কে মল্লিক ছদ্মনাম নিয়েছিলেন। অমৃক সিং অরোরা পাঞ্জাবি হয়েও সারাজীবন কালীর গান গেয়ে কাটালেন। নিজ বাসভবনে কালী মন্দির পর্যন্ত গড়েছিলেন।
পান্নালাল, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যরা ‘শ্যামাসঙ্গীত’কে মূল ধারার সঙ্গীতের আসনে বসিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। মান্না দে-র ‘আমায় একটু জায়গা দাও মায়ের মন্দিরে বসি’ বা কুমার শানুর গলায়, ‘বসন পরো মা...’, ‘তুই নাকি মা দয়াময়ী’, ‘শ্যামা মা কি আমার কালো’ ইত্যাদির মতো গানগুলি আরও জনপ্রিয় করেছে শ্যামাসঙ্গীত ঘরানাকে। অরিজিৎ সিংহের গলায় রামপ্রসাদী গান ‘মন রে কৃষি কাজ জানো না...’ জেন জ়ি, মিলেনিয়ালদের মাদকতায় ভাসিয়েছে।
যখন গাওয়া হয়, ‘আমার চেতনা চৈতন্য করে দে মা চৈতন্যময়ী/ তোর ভাব সাগরে ভেসে আমি হব মা তোর পদাশ্রয়ী।’ তখন এ গান কি আর নিছক গানের পরিচয়ে আটকে থাকে? হয়ে ওঠে আত্মনিবেদনের স্তব। ‘কালো রূপে দিগম্বরী,/ হৃদিপদ্ম করে মোর আলোরে,/ শ্যামা মা কি আমার কালো।...লোকে বলে কালী কালো, /আমার মন তো বলে না কালো রে...’ এই গানের চেয়ে সহজ-সরল পথে কালীর স্বরূপ ব্যাখ্যা করার অন্য কোনও উপায় কি আছে? এ ভাবেই শ্যামাসঙ্গীত গানের পরিচয় ছাপিয়ে মিশে গিয়েছে কালী আরাধনার সঙ্গে। হয়ে উঠেছে বাঙালির কালীপুজোর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।