প্রেজেন্টস্
Knowledge Partner
Fashion Partner
Wedding Partner
Banking Partner
Comfort Partner

পান্নালাল-ধনঞ্জয়ের গান ছাড়া অসম্পূর্ণ বাঙালির শ্যামাপুজো! কী ভাবে দুই ভাইয়ের গানে শুরু হয় কালী আরাধনা?

বাঙালির ঘরে কালী আসেন তাঁর গানের পথটি ধরেই। জেগে ওঠেন রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত।

আনন্দ উৎসব ডেস্ক

শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০২৫ ১৮:১১
প্রতীকী চিত্র

প্রতীকী চিত্র

‘সদানন্দময়ী কালী

মহাকালের মনমোহিনী…’

হেমন্তের হাওয়া, শেষ শরতের রোদ্দুর ছুঁয়ে এ গান বেজে উঠলেই কালী নামে ডুব দিতে চায় মন। ফুলের দোকান কিংবা পাড়ার মন্দির, যেখান থেকেই ভেসে আসুক না কেন, এ ডাক সেই কালো মেয়ের ডাক। এক অমোঘ কড়ানাড়া যেন। যে শুনেছে সে জানে, মুক্তকেশীর মায়া বেড়ি কাটছে মনে। আর ভগীরথ 'পান্নালাল'।

দীপান্বিতা উৎসবের আবাহন হয় তাঁকে দিয়েই। পান্নালাল ভট্টাচার্য। শ্যামা মায়ের খাস তালুকের খাস প্রজা।

বাঙালির ঘরে কালী আসেন তাঁর গানের পথটি ধরেই। জেগে ওঠেন রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত।

কালীপ্ৰিয় জাতির কাছে কালীর গান আর পান্নালাল সমার্থক। তিনি গায়ক তিনিই সাধক।

সাচ্চা মোহনবাগানভক্ত, ঘুড়িপাগল, মাছ ধরায় ওস্তাদ তরুণ জীবনের শুরুতে ভেবেছিলেন সিনেমায় প্লেব্যাক করবেন, আধুনিক বাংলা গান গাইবেন। এমনকি সিনেমা করতে চেয়ে দাদার হাতে চড়ও জুটেছিল। কিন্তু তাঁর নিয়তি ছিল কালী। সে পথেই আবর্তিত হল তাঁর জীবন।

পান্নালালের জীবনের কম্পাস ছিলেন তাঁর 'মেজদা'। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। আধুনিক বাংলা গানের অন্যতম দিকপাল, ভক্তিগীতির প্রধান কণ্ঠ নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন ভাইয়ের জীবনের গতিপথ। ১১ ভাইবোনের মধ্যে কনিষ্ঠতম 'পান্না' তাঁর কাছে পুত্র সমান। ধনঞ্জয় ছিলেন পান্নালালের চেয়ে সাত বছরের বড়। মা অন্নপূর্ণার অষ্টম গর্ভের সন্তান।

পান্না যখন মাতৃ জঠরে তখনই পিতৃহারা হন। তাই আত্মীয়দের কাছে দেগে গিয়েছিলেন 'অপয়া' নামে। অনাদর-অবহেলা ছোটবেলার সঙ্গী। তবে আগলে রাখত মা আর মেজদার স্নেহ। পান্নালালের কাছে মেজদাই 'বাবা'র মতো।

ছোট থেকে ভারী মায়া জড়ানো গলা। ভাইকে গান শেখাতেন ধনঞ্জয়। গান শেখানোর জন্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, সঙ্গীতকার যামিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছেও নিয়ে যান।

পান্নালালের কণ্ঠে ছিল এক অন্য রকম কাতরতা। গলার মায়া, আকুলতা ভক্তি রসের গানের জন্য আদর্শ। ধনঞ্জয়ই ভাইকে দিয়ে ভক্তিগীতি রেকর্ড করানোর সুপারিশ করেন। তিনিই ভাইকে হাতে ধরে এইচএমভি-তে নিয়ে যান।

মানুষকে কাঁদাতে পারত পান্নালালের কণ্ঠ। তাঁর গান সুরধনীর মতো উদাস। মৃন্ময়ীকে চিন্ময়ী রূপে জাগাতে পারতেন তিনি।

অতুলকৃষ্ণ মিত্রের লেখা তাঁর গাওয়া 'আমার সাধ না মিটিল' সম্পর্কে সুধীর চক্রবর্তী বলেছিলেন ' গড় বাঙালির সবচেয়ে আন্তরিক মর্ম গাথা'।

দাদা ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য বলতেন, " পান্নার মতো ও রকম নাড়ি ছেঁড়া মা ডাক ডাকতে পারলাম কই!"

আর ভাই বলতেন "দাদার তুলনা দাদা-ই।"

৫০-এর দশকের মাঝামাঝি। বংশী আশের পরিচালনায় 'সাধক রামপ্রসাদ' ছবিতে তেইশশো টাকা সম্মান দক্ষিণায় ২৩টি গান গেয়েছিলেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। 'তিলেক দাঁড়া ওরে শমন', 'মা মা বলে আর ডাকব না', 'মুক্ত কর মা মুক্তকেশী' গানে আজও তিনি কাঁদান শ্রোতাদের।

অন্তর নিংড়ানো 'জাগো মা' কাঁপন ধরায় উচ্চারণে। দাপুটে স্রোতের মতো ভাসিয়ে নিয়ে যান। আরতির শঙ্খধ্বনির মতো গমগমে কিন্তু কোলের শিশুর কান্নার মতো ব্যাকুল। যার টানে আজও তোলপাড় হয় অতিব্যস্ত মানুষের হৃদয়ও!

যোগাচার্য নগেন্দ্রনাথ ভাদুড়ী ছিলেন তাঁদের বংশপুরুষ। তাঁর গানের মুগ্ধ শ্রোতা ছিলেন স্বয়ং রামকৃষ্ণদেব। পৌরোহিত্য করার জন্য এই বংশ 'ভট্টাচার্য' উপাধি পায়। তাঁদের আদি ভিটে হাওড়া জেলার পায়রাটুঙি গ্রাম। পরের নিবাস বালি।

নগেন্দ্রনাথ ভাদুড়ীর ভাইপো সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ধনঞ্জয় ও পান্নালালের পিতা।

তাঁদের মায়ের গানের গলা ছিল খুব মিষ্টি। গানের ধারা আর বংশের শাক্ত প্রভাবে মিশেই হয়তো কালীর নামগানে দিকপাল হয়ে উঠেছিলেন দুই ভাই।

পান্নালাল জানতেন, তাঁর দাদার মাতৃদর্শন হয়েছিল। ঈশ্বরভক্ত ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যর জীবনে বারবার অলৌকিক ঘটনা ঘটেছে।

পান্নালাল তাঁর মাকে খুঁজেছিলেন জীবনে-মরণে। শ্যামসঙ্গীত গাওয়ার পরে আর অন্য গান গাননি। তাঁর খেদ ছিল মাতৃদর্শন না পাওয়ার। তাই শ্মশানে শ্মশানে ঘুরে বেড়াতেন।

কখনও কেওড়াতলা, কখনও সিরিটি, কখনও বা বারেন্দ্র পাড়ার শ্মশান ঘাটে বসে থাকতেন, আর কাঁদতেন। বলতেন, “আমি তো চিরকাল ঈশ্বরের গান গেয়ে বেড়ালাম। আমার ঈশ্বর দর্শন হবে না কেন? কেন আমায় দেখা দিবি না মাগো?”

লোকে বলত "পান্নালাল কী ভাবে অমন গান?"

গানের দুনিয়া তাঁকে পেয়েছিল ১৯ বছর। ১৯৬৬ সাল তাঁর জীবনের শেষ বছর। 'অপার সংসার নাহি পারাপার' রামপ্রসাদী গানে সুর ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের। কণ্ঠ দিলেন পান্নালাল।

২৬ মার্চ কাঁকুলিয়া রোডের বাড়িতে পরপারে পাড়ি দিলেন পান্না। ৩৬ বছর বয়সে স্বেচ্ছায় আত্মবিসর্জন। ঘুম থেকে তুলে মেজদা ধনঞ্জয়কে দেওয়া হল সেই দুঃসংবাদ– 'পানু আর নেই!'

ভাইয়ের চলে যাওয়ার শোক ধনঞ্জয় মানতে পারেননি। বলেছিলেন, "সত্যিকারের মাতৃদর্শন ওরই হয়েছিল। আধারটা তৈরি হয়নি বলে নিজেকে ধরে রাখতে পারল না।"

এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy