বাংলায় রামায়ণ রচনা করেছিলেন ফুলিয়ার কৃত্তিবাস ওঝা। তাঁর ‘শ্রীরাম পাঁচালী’-তে রয়েছে শ্রীরামচন্দ্র দেবী দুর্গার অকাল বোধন করেছিলেন। (আষাঢ় থেকে কার্তিক দেবদেবীর নিদ্রাকাল। তাই অকাল বোধন।) সীতা উদ্ধার ও লঙ্কাধিপতি রাবণের বিরুদ্ধে জয় পেতেই দেবীর শরণাপন্ন হয়েছিলেন রাম। মিলেছিল তাঁর আশিস। দেবী দুর্গা দশরথপুত্রকে বলেছিলেন, ‘‘রাবণে ছাড়িনু আমি/ বিনাশী করহ তুমি।’’
কিন্তু ভারতের আর এক মহাকাব্য, মহাভারতে কি আছেন দেবী দুর্গা? কথায় বলে, যা নেই মহাভারতে, তা নেই ভারতে। আবার রবি ঠাকুর বলে গিয়েছেন, ‘মহাভারত না পড়িলে আমাদের দেশের কাহারো শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় না।’ এমন এক কাব্যে দেবী দুর্গা থাকবেন না? অবশ্যই আছেন।
মহাভারতের বিরাট পর্বে প্রথম দেবী দুর্গার উল্লেখ পাওয়া যায়। পাশা খেলায় পরাজয়ের শর্ত অনুযায়ী দ্রৌপদী-সহ পঞ্চপাণ্ডবকে বারো বছরের বনবাস এবং আরও এক বছরের অজ্ঞাতবাসে যেতে হয়েছিল। এক যুগ বনবাসের পরে পঞ্চপাণ্ডব অজ্ঞাতবাসের জন্য বিরাটনগরকে বেছে নেন। শর্ত ছিল, অজ্ঞাতবাস পর্বে কেউ তাঁদের খোঁজ পেলে আরও বারো বছরের জন্য বনবাসে থাকতে হবে কুন্তীর পাঁচ পুত্র ও তাঁদের পত্নী দ্রৌপদীকে। নির্বিঘ্নে অজ্ঞাতবাস পর্ব অতিবাহিত করার কামনায়, মুনিঋষিদের পরামর্শে জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব যুধিষ্ঠির দেবী দুর্গার কাছে প্রার্থনা করেন।
যুধিষ্ঠির স্তব করেন, ‘দুর্গাৎ তারয়সে দুর্গে তৎ ত্বং দুর্গা স্মৃতা, জনৈ।’ যুধিষ্ঠিরের আরাধ্যা দেবী দুর্গা ছিলেন চতুর্ভুজা, চতুর্বক্তা ও সিংহারূঢ়া। তাঁর গাত্র অতসী বর্ণের। দেবতাদের তেজ থেকেই তাঁর সৃষ্টি। মহিষমর্দিনীর ঘোর রূপের আরাধনা করেছিলেন যুধিষ্ঠির। দুর্গাকে মহিষাসুরনাশিনী ভগবতী বলেছিলেন জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব। দেবী সন্তুষ্ট হয়ে বলেছিলেন, ‘যে নিষ্পাপ ব্যক্তি আমার নাম স্মরণ করে, তার কোনও দুর্লভ বস্তুই অপ্রাপ্য থাকে না।’ কৌরবদের পরাজিত করে রাজ্য ফিরে পাওয়ার বর দিয়েছিলেন দুর্গা।
বিরাট পর্বের পর ভীষ্ম পর্বেও দুর্গার উপাসনা করেছিলেন পাণ্ডবরা। কুরুক্ষেত্র ছিল ভাইয়ে ভাইয়ে লড়াইয়ের মঞ্চ। কৌরবদের পক্ষে নিজের আত্মীয়-প্রিয়জনদের দেখে অর্জুন অস্ত্র ধরার বিষয়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। আবার কৃষ্ণের নারায়ণী সেনা-সহ দুর্যোধনের সেনাবাহিনী দেখে বীর অর্জুনও খানিক টলে গিয়েছিলেন। পথপ্রদর্শক হয়ে তখন পথ দেখান মধুসূদন শ্রীকৃষ্ণ। কৃষ্ণই অর্জুনকে দুর্গার উপাসনা করার উপদেশ দেন। স্তোত্রপাঠ শুরু করেন অর্জুন। দেবী প্রসন্ন হয়ে অর্জুনকে শত্রুবিজয়ী হওয়ার বর দান করেন। দুর্গার আশীর্বাদে অর্জুন তথা পাণ্ডবেরা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে জয়ী হন।
ভারতের দুই মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারত। দুই আখ্যানের মূল বক্তব্যই এক, ন্যায়ের জয় অনিবার্য। দুই মহাকাব্যে অন্যায়কে হারিয়ে ন্যায়ের জয়ের মাধ্যম হলেন যথাক্রমে রাম ও অর্জুন। পৌরাণিক কাহিনির কী অদ্ভুত সমাপতন! দুষ্টের দমনের জন্য রাম ও অর্জুন দু’জনেই দেবী দুর্গার শরণাগত হয়েছিলেন। দেবীর আশীর্বাদে দু’জনেই জয়ী হন।
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।