বাড়ির সকলের মুখ কালো। এত দিনের পুজো তাদের! প্রায় ৩৫০ বছর হয়ে গিয়েছে, এখন যদি এমন বিপত্তি আসে! তা হলে কেমন করে মন মানে…
তবে কি তাদের কোনও ত্রুটি হয়েছে? দেবী কি তাদের হাতে পুজো নিতে চান না?
তখন গৃহকর্ত্রী ঢাকার দেওয়ান রাধামাধব বসুর বিধবা স্ত্রী বিন্দুবাসিনী দেবী। দেবীর কাছে কেঁদে পড়েন তিনি– মা এ তোমার কেমন ছলনা! কেন তোমার মূর্তি সম্পূর্ণ হচ্ছে না…
দেবী দেখা দেন। বলেন, “ যখন হাত নিয়ে এত সমস্যা, তখন হাতগুলি ছোট করে দিলেই হয়। ” ব্যস, সেই শুরু…
এই ঘটনা ১৭৯৭ সালের। মোটামুটি ১৪৬০-৭০ থেকে শুরু হয়ে ৩৩৩ বছর দেবী দুর্গা পুজো পেয়ে আসছেন বসু বাড়িতে। বাংলার অন্যতম প্রাচীন দুর্গাপুজোগুলোর অন্যতম এই বসুবাটির পুজো। প্রায় তাহেরপুরের দুর্গাপুজোর সমসাময়িক।
বেশ চলছিল। গোল বাধল ১৭৯৩ সালে। বর্ষণক্লান্ত বছর, মাটি লাগিয়ে শুকোনোর জন্য রেখে দেওয়া হয়েছে প্রতিমা। দালানের পায়রারা এসে বসে মায়ের কৌণিক হাতগুলির উপরে। এত দিন সমস্যা হয়নি, কিন্তু সে দিন নরম হাতগুলি ভেঙে গেল। একে এই ভীষণ ঝড়-বাদল। তার পরে দেবীর হাত ভেঙে যাওয়া। এখন নতুন মূর্তি গড়া অসম্ভব। আর তা ছাড়া মাতৃমূর্তিতে মাটি দেওয়ার দিনক্ষণ নির্দিষ্ট। কল্পারম্ভ বা বোধন নির্দিষ্ট। চাইলেই তো নিয়ম ভাঙা যায় না।
সংগৃহিত চিত্র
তাই দেবীর হাত মেরামত করেই হল পূজা। ঠিক হল, পরের বছর দুর্গার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে মূর্তি গড়ার আগে। শোনা যায়, মূর্তি গড়ার আগে প্রায়শ্চিত্ত করে কাজ শুরু হয়। কিন্তু কোথায় কী! সেই একই হাল। তার পরের বছর, তারও পরের বছর এক ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকে। সারা দিন-রাত লোক সতর্ক থাকে। পায়রার দল ত্রিসীমানায় দেখলেই তাড়া করে। তবুও কখন, কী ভাবে যেন তারা এসে বসে। এবং ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। না, এ কোনও সাধারণ ঘটনা তো নয়। এ দেবীরই কোনও ইঙ্গিত। উমার কাছে কেঁদে পড়েন বাড়ির সবাই।
বাড়ির কর্ত্রীকে স্বপ্ন দিলেন দেবী। তার পর থেকেই মূল দুই হাত রইল বড়, অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ। আর বাকি আটটি হাত হল ছোট ছোট, এক-দেড় ফুটের ভিতরে। ছোট হাত যায় না, পায়রাও আর বসে না। কদাচিৎ বসলেও এই ছোট হাত ভাঙল না আর।
সেই ১৭৯৭ সাল থেকে আজ ১২৮ বছর ধরে সেই অদ্ভুত রূপেই দুর্গামূর্তি পুজো পেয়ে আসছে। দূর থেকে প্রতিমার হাতগুলি যেন কলার ছড়ের মতো মনে হয়। লোকমুখে তাই বসু বাড়ির সেই আদি দুর্গাপুজো নাম পেল কলার ছড়ের দুর্গাপুজো।
সুপ্রাচীন কাল থেকেই এই পুজো বড় অদ্ভুত। শুরু করেছিলেন ঈশ্বরীগুপ্ত বসু। যিনি প্রতাপাদিত্যের পুত্র কীর্তিনারায়ণ বসুর দাদামশাই। বাংলাদেশের মাহিনগর থেকে এসে তিনি পৌঁছেছিলেন বসিরহাটে।
ঈশ্বর বসু দণ্ডীরহাট ইজারা নিয়ে জমিদারি পত্তন করেন। হিন্দু-মুসলিম সকল প্রজাকে মিলিয়ে তিনি শুরু করেছিলেন দুর্গাপুজো। তাই আজও নিরঞ্জনের জন্য প্রতিমা যায় মুসলিম পাড়ায়। মোকসেদ মোল্লার বাড়ির উঠোনে রাখা হয় মাতৃপ্রতিমা। মুসলিমরাও হিন্দু রীতিতে সিঁদুর উৎসবে মেতে ওঠেন। তার পরে ধীরে ধীরে নিরঞ্জনের পথে অগ্রসর হন দেবী। এ ভাবে পথে মোট চার জায়গায় রাখা হয় প্রতিমা।
আজও বাগবাজারের গঙ্গার ঘাট থেকে জোয়ারের জল ভরে আনা হয়। সেই জলেই হয় দুর্গা পুজো। পারিবারিক নিয়ম এখনও মেনে চলা হয় সম্পূর্ণ ভাবে। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ ভিড় জমান এই অদ্ভুত বিষমবাহু ‘কলা ছড়ের মাতৃপুজো’ দেখতে।