বৈশাখের খরদুপুর। বাড়িতে খাবার তেমন কিছু নেই। দেবী দুর্গা ক্রোধে ঘর-বার করছেন।
মহাদেব গিয়েছেন ভিক্ষায়। খাদ্যদ্রব্য এবং সেই সঙ্গে শাঁখা আনবেন। তাঁর স্ত্রী মহামায়ার ডান হাতের শাঁখাটি বেড়েছে (চিড় ধরেছে)। কিন্তু তিনি আর আসেন না। দুর্গার ক্রোধ বাড়তে থাকে।
তিনি যে মহামায়া। তাঁর হাতে গোটা বিশ্বসংসার। আঁচলে মানুষের সুখ-দুঃখ, ভাগ্য বাঁধা। তাঁর হাতের শাঁখা বেড়ে যাওয়া মানে তাবড় সংসারের অকল্যাণ। দেবী অস্থির হয়ে ওঠেন জগতের কল্যাণ চিন্তায়।
সকাল গড়িয়ে দুপুর, অবশেষে মহাদেব ফিরলেন। অল্প চাল, ডাল এনেছেন বটে, কিন্তু আসল জিনিসটাই আনেননি। শাঁখা চাইতেই জিভ কাটলেন মহাদেব। ভুলে গিয়েছেন। দুর্গা ক্রোধান্বিত ও অভিমানী হয়ে চলে গেলেন বাপের বাড়ি। আর তিনি সংসারে ফিরবেনই না!
দিন যায়, কাল যায়। দুর্গা আর ফেরেন না। এ দিকে কৈলাসের সংসার যে চলে না! নন্দী, ভৃঙ্গীরাও মা মা করে অস্থির করে। অতএব মহাদেব স্ত্রীর রাগ ভাঙাতে চললেন শাঁখারি বেশে।
শ্বশুরবাড়ির সামনে একটি গাছের তলায় শাঁখারি-রূপী জামাই মহাদেব শাঁখার পসরা সাজিয়ে বসলেন। শ্বশুরবাড়ির কেউ তাঁকে চিনতে পারল না। কিন্তু দুর্গা তাঁর পতিকে ঠিকই চিনে নিলেন। দেবীর রাগ ভাঙল।
শাঁখা পরে, বাপের বাড়িতে দু’জনে একসঙ্গে কিছুকাল অবস্থান করলেন। সেখানে তাঁদের এক কন্যার জন্ম হল। সেই সন্তানকে বাপের বাড়ি রেখে হর-পার্বতী ফিরে গেলেন নিজ সংসারে।
বিষয়টি বেদনাহত করে ঠিকই, কিন্তু সে সময়ে অভাবের সংসারে অনেকেই এমন ভাবে মামার বাড়িতে বড় হত। আর দুর্গার তো বিশ্বসংসার। স্বামী মহাদেব শ্মশানে শ্মশানে ঘুরে বেড়ান। অভাব সদাই।
সেই কন্যা বড় হয়। ক্রমশই মর্ত্যের মা হয়ে ওঠে সে। দেবী দুর্গার ক্ষুদ্র প্রতিরূপ দেবী বনদুর্গা। মায়ের থেকেই মা আসে। তাই মা দুর্গা কন্যা বনদুর্গাকে রেখে গিয়েছিলেন দুর্গা স্বরূপিনী হিসেবে। মর্ত্যের মানুষের দুঃখকষ্ট, জ্বালা-যন্ত্রণা সব কিছু সামলাবেন তিনি। তিনি বঙ্গদেশের অন্যতম লৌকিক দুর্গা, দেবী বনদুর্গা।
।।রূপ।।
বাঘের পিঠে চতুর্ভুজা বরাভয়দায়িনী দেবী বনদুর্গা। এই বাঘ কখনও পার্বতী দুর্গার সঙ্গে মিলিয়ে সিংহ হয়েছে। আবার কোথাও তিনি সাক্ষাৎ বনদেবী। হরিণ তাঁর বাহন।
দেবীর বেশবাস, শৃঙ্গার বনকন্যার মতো। তাই কেউ কেউ আবার বনদুর্গাকে বনদেবী আখ্যায়িত করেন। আদিম কালে দেশ আর অরণ্য সমার্থক ছিল। অরণ্যাচারী মানুষের খাদ্য থেকে পোশাক, জীবনযাপন সবই অরণ্যনির্ভর ছিল। সেই অরণ্য বা প্রকৃতিকেই তাঁরা দেবীরূপে মানতেন। নারী থেকেই সৃষ্টি হয়। তাই অধিষ্ঠাত্রী দেবীই বনদেবী/ বনদুর্গা।
।। পূজা পদ্ধতি।।
মর্তের সাধারণ জনগণের পূজ্য দেবী বনদুর্গা। তাই তাঁর পূজা পদ্ধতি অত্যন্ত সাধারণ। ভক্তি, শ্রদ্ধা এবং নিবেদনেই তিনি তুষ্ট।
ধরা যাক, শীতের শেষে ঘরে নতুন ডাল উঠেছে। তা হলে খেসারি কলাইয়ের ডাল দিয়ে ভোগ দেওয়া যাবে দেবীকে। কিম্বা পুকুরে মস্ত একখানা রুই উঠেছে। রুইয়ের মুড়োটি দিয়ে দেবীর ভোগ হল। আদ্যোপান্ত ঘরের গৃহকর্ত্রীটিই তিনি।
এছাড়া, শনি-মঙ্গলবারে কোন শেওড়া বা পাকুড় গাছের তলায় দেবীর থান বা পটে তাঁর পুজো হয়। যেখানে কোনও গাছ নেই, সেখানে উক্ত গাছের ডাল পুঁতে মায়ের পুজো করা যেতে পারে ।
এ ছাড়াও, যে কোনও শুভ অনুষ্ঠান যেমন, অন্নপ্রাশন, বিয়ে, জাতকর্ম ইত্যাদিতে দেবীর পুজো দিতে হয় সর্বাগ্রে। কারণ বনদুর্গাই হলেন শস্যপ্রদায়িনী, শিশুরক্ষক, গোসম্পদ রক্ষক, মঙ্গলদায়িকা। তিনি তুষ্ট হলেই সুফল লাভ হয়।
ঢাকার ধামরাই, রঘুনাথপুর, নবাবগঞ্জ কিম্বা ময়মনসিংহ, শ্রীহট্টের পরগনাগুলিতে দেবীর পূজাপাঠ হয়।
আরও পড়ুন:
দেবী বনদুর্গার নৈবেদ্য সাজানোর নিয়মটি ভারি অদ্ভুত। কলা গাছের আগ পাতা অর্থাৎ পাকিয়ে থাকা পাতাটির আগা কেটে তার মধ্যে সাজানো হয়। এই সাজানোটিকে বলা হয় 'ঠাঁইৎ'।
এই ভোগ দেবীকে নিবেদন করা হয়। কথিত, দেবী কাক রূপ ধরে আসেন এবং প্রসাদ গ্রহণ করেন। কাক এসে তাই ভোগে ঠোক্কর মেরে যায়। যদি কাক এসে প্রসাদ না ছোঁয়, তা হলে ধরা হয় কোনও ত্রুটি হয়েছে।
তখন গলায় কাপড় দিয়ে দেবীর পটের সামনে প্রায়শ্চিত্ত প্রক্রিয়া করতে হয়। আকুল হয়ে কেঁদে পড়ে, ক্ষমা চেয়ে আবারও ভোগ রেঁধে নিবেদন করতে হয়।
পাঠক কুল বুঝতে পারছেন যে, কী ভীষণ ব্যবহারিক শিক্ষা! দেবী দুর্গা এই রূপে সর্বসাধারণের দুর্গা প্রতিরূপা। তাই শাস্ত্রীয় বিধির বাইরে গিয়ে সকল জনের আয়ত্তের মধ্যে তিনি। এবং সেই সঙ্গে যে পাখিকে অশুভ ভাবা হয়, সেই কাককে মান্যতা দিচ্ছেন দেবী। যে শ্যাওড়া গাছকে অভিশপ্ত মনে করে অহেতুক কেটে ফেলা হয়, তাকেও নিজের অধিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করে তার অস্তিত্ব রক্ষা করছেন দেবী।
সত্যিই তো, মা দুর্গা জীব ও জড় কুল– সবাইকে রক্ষা করেন। চেতনা প্রদান করেন মানুষকে। দুর্গাপুজোর প্রাক্কালে এটাই হওয়া উচিত মূলমন্ত্র।
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।