দৈত্য বিনাশ হেতু দ অক্ষর হইল।
বিঘ্ননাশ করে উ-কার যুক্ত হইল।।
রেফ যুক্ত হয়ে সর্ব রোগ বিনাশিলেন।
গ অক্ষরে সকল পাপ অসিতে কাটিলেন।।
আ অক্ষর দ্বারা দেবী আদ্যন্ত হইলেন।
মারি-অরি, ভয়- ত্রাস মুদগলে দলিলেন।।
সর্ব অক্ষর জুড়াইয়া দুর্গা নাম হইল।
ত্রিলোকবাসী দেবীর অঞ্চলে প্রশ্রয় পাইল।।
অর্থাৎ মা দুর্গা এই দুর্গা শব্দটিকে যদি বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে দেখা যাবে এটি আদতে একটি আশ্বাস বার্তার সমষ্টি মন্ডলী। যেখানে -
'দ' দৈত্যনাশক
'উ-কার' বিঘ্ননাশক
'রেফ' রোগনাশক
'গ' অক্ষর পাপনাশক
'আ-কার' ভয়- শত্রুনাশক
অর্থাৎ 'দুর্গা' মাতৃরূপে এই সকল হয় হতে আমাদের উদ্ধার করেন। তার স্নেহ অঞ্চলে বা আঁচলে আমরা নিশ্চিন্তে থাকি।
তাহলে, মা দুর্গা আশ্বাসের একটি সমষ্টি বা জাগতিক ভয়হীনতা। একেই ভেঙ্গে ভেঙ্গে বিভিন্ন রূপে বিভিন্ন সময় প্রকাশ করা হয়েছে। যেমন শব্দকল্পদ্রুম বলছে,
'দুর্গং নাশয়তি যা নিত্যং সা দুর্গা বা প্রকীর্তিতা' অর্থাৎ দুর্গ প্রকান্তরে দুর্গম নামক অসুরকে যিনি নাশ করেন। তিনিই দুর্গা নামে অভিহিত।
দেবী ভাগবত পুরাণ এর কথায়, “অসুররাজ হিরন্যাক্ষ তো শ্রীবিষ্ণু হস্তে নিহত হলেন। বিষ্ণুর সেই অবতার বরাহ অবতার। কিন্তু তার পুত্র রুরুর জীবিত ছিলেন। এবং তার দ্বারা জীবিত ছিল হিরণ্যাক্ষর বংশগতি। সেই বংশধর আপন পিতৃপুরুষের হত্যার প্রতিশোধ নেবার উদ্দেশ্যে কঠিন তপস্যায় রত হলেন। অনেকেই তাকে টলানোর চেষ্টা করল। কিন্তু তার সাধন এবং মনোবল দুর্গের মতই অটুট। কিছুতেই তাকে ভাঙা গেল না। ব্রহ্মাকে সন্তুষ্ট হয়ে সেই অসুরকে দর্শন দিলেন। অসুর এক অদ্ভুত বর চেয়ে বসলেন, তাকে হত্যা করতে পারে কেবলমাত্র একজন নারী। এবং সেই নারীও আবার বিশেষ পারদর্শী হতে হবে৷ “অনাবদ্ধ”কে বদ্ধ করতে জানবে।
এই জগতে অনাবদ্ধ বা বাঁধনহীন দুটি জিনিস; কাল এবং মহাকাশ! এই দুইকে বদ্ধ করতে পারা এক প্রকার অসম্ভব। তাই এই অসুরও অবাধ্য হয়ে উঠলো। তাকে জয় করা এবং বধ করা হয়ে উঠল দুর্গম। সে দুর্গের মতোই কঠিন দুর্ভেদ্য। তার নাম হলো দুর্গমাসুর।
দেবতাদের প্রতি ক্রোধে উন্মত্ত অসুর তাদের বিপত্তিতে ফেলার চেষ্টা করতে লাগল। এই উদ্দেশ্যেই সে হরণ করল চার বেদ অর্থাৎ মন্ত্র। দেবতারা পড়লেন সমস্যায় মন্ত্র যদি বাজেয়াপ্ত করে অসুর। তাহলে যাজন কর্ম বন্ধ হয়ে যাবে। যাগ-যজ্ঞ না হলে দেবতাদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত আহুতি, নৈবেদ্য এসে পৌঁছাবে কি প্রকার! তদুপরি মন্ত্রহীন মানুষ প্রায় অন্ধ! মন্ত্র ও ব্যাখ্যা উপলব্ধি দেয়, মানুষকে অন্তর দর্শন করায়।
বিন্ধপর্বত এর গিরি প্রান্তরে দেবী দশভুজা দশায়ুধাধারিনী হয়ে সমরে আহ্বান করলেন দুর্গমকে। দেবীর অংশ-রা ক্ষণে ক্ষণে রূপ পরিবর্তন করে কখনো ভয়ঙ্করী, কখনও মহা রৌদ্র বিনাশিনী হয়ে বিনাশ করলেন দুর্গমের কোটি সংখ্যক সৈন্য বাহিনীকে। অবশেষে দেবী আপন হস্তের শূল বা বল্লম দিয়ে বিদীর্ণ করলেন দুর্গমাসুরের বক্ষ।
দুর্গম বুঝতে পারল, সত্যিই তো এই সেই নারী। যিনি কাল অর্থাৎ সময়কে কলন করছেন। স্বয়ং মহাকালের তিনি পত্নী। তিনি নিজেই শূন্যরূপা। উদ্ধার করলেন সকল মন্ত্রের আধার (পাত্র) বেদ চতুষ্টয় বা চার বেদ। দেবী প্রসিদ্ধ হলেন সর্বমন্ত্রময়ী নামে।
ততক্ষণে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে দুর্গমাসুর। মায়ের কাছে করজোড়ে ক্ষমা চাইছে সে। আর তিনিও তো মা! সৎ ও অসৎ, সু ও কু সবাই তাঁর সন্তান। তাই দুর্গমকে দয়া করলেন তিনি। তাকে দান করলেন বোধি বা বোধ। সেই বোধের দ্বারা দুর্গম বেদ সার উপলব্ধি করল। অনুতাপের আগুনে ও মাতৃস্নেহে মনের দুর্গমতা সুগম হল। মাতৃ কৃপার আলোকে আলোকিত হল তার মনের অন্ধকার কোণটি। দুর্গমের দুর্ভেদ্য দুর্গ হতে ত্রাণ পেল জগতবাসী তাই মা হলেন দুর্গা।
কেবল বেদ পুরাণের কথা নয় আমরা সকলেই আমাদের মনের ভেতর এক একটি দুর্গম। অনেক অন্যায়, পাপ, হিংসা, মিথ্যা ও লোভের পাঁচিল তুলে আমাদের মনকে দুর্ভেধ্য দুর্গে পরিণত করে রেখেছি। সেই দুর্গম পথ বেয়ে সহজে আলো পৌঁছাতে পারে না আমাদের মনে। কিন্তু মা দুর্গার নিয়ত আরাধনায়, তার মন্ত্রের পাঠে ও উপলব্ধিতে আমাদের মনের কোণে আলো পৌঁছাবে। আলোকিত হবে সকল কিছু। তাইতো তিনি দেবী দুর্গা।
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।