গড়ে উঠল দেবী দুর্গার মন্দির। আদ্যাশক্তি মহামায়া নিজের মধ্যে থেকেই উত্থিতা। তাই, সেই জায়গার নাম হল মহামায়াপাট।
হিসসস….শব্দটা শুনে সতর্ক হয়েছিল শ্রমিক দল। সঙ্গে সঙ্গে বড় বড় হ্যাজাকগুলোর মুখ ঘুরিয়েছিল শব্দের উৎসের দিকে। যা অনুমান করা গিয়েছিল, ঠিক তাই। সাপ! গাঁইতি হাতে এগিয়ে গেল চার-পাঁচ জন শ্রমিক। সন্তর্পণে, সতর্ক ভঙ্গিতে… গাঁইতিটি তুলে সবে আঘাত করতে যাবে। ঠিক সেই মুহূর্তে দৃশ্যমান হল সবটুকু। হাত থেকে খসে গেল গাঁইতি। হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল তারা। কী আশ্চর্য, সাপটিও পাল্টা আক্রমণ না করে পাথরের গা থেকে নিজের প্যাঁচ খুলে সড়সড় করে হারিয়ে গেল পিছনের ঘন জঙ্গলে। যেন তার কাজটাই ছিল দৃষ্টি আকর্ষণ করা।
১৮৯০ সাল। তরাই অর্থাৎ ডুয়ার্সের জয়ন্তী থেকে রংপুর পর্যন্ত রেললাইন পাতার কাজ চলছে। মূলত চা বাগানের স্বার্থে এই সমস্ত অঞ্চলে তখন ওই কাজ চলছিল। ঘন জঙ্গলের বুক চিরে চলবে রেললাইন। তাই অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করে পুরো দমে চলছিল কাজ।
কাজ করতে করতে শ্রমিকেরা দিনহাটার কাছে এসে পৌঁছেছে। গভীর রাতে কাজ করার সময় আবিষ্কৃত হল এক প্রস্তরখণ্ড। সেই পাথরকে পেঁচিয়ে ধরেছিল একটি বৃহৎ শঙ্খচূড় বা কিং কোবরা। শ্রমিকেরা সতর্ক হয়ে গাঁইতি-শাবল হাতে এগিয়ে গিয়েছিল। সুপারভাইজার তাক করেছিল বন্দুক। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, হিংস্র স্বভাব সেই রাজসর্প নিজে থেকেই ফনা নামিয়ে সরে যায়।
পাথরের গায়ে তখন দৃশ্যমান হয়েছে অপূর্ব এক দেবীমূর্তি। বিশ্বাস স্থির হয়, সেই মূর্তিকেই পাহারা দিচ্ছিল সাপটি। তার হিসহিসানি কেবলমাত্র দৃষ্টি আকর্ষণের উদ্দেশ্যে। না হলে ক্রুদ্ধ শঙ্খচুড় ফণা নামিয়েছে, এমন অদ্ভুত ঘটনা শোনা যায়নি কখনও। এ যে তার স্বভাবের বিপরীত!
ভক্তিভরে সেই প্রস্তর খণ্ডটিকে তুলে আনল শ্রমিকের দল। কালের নিয়মে ক্ষয় হয়েছে, অবয়ব অতখানি সুস্পষ্ট নয়। তবুও স্পষ্ট বোঝা যায় সে মূর্তি দশভুজা দেবী মহামায়ার।
দিনহাটার ওই এলাকার নাম চওড়াহাট। সেখানেই শ্রমিকরা তাদের বসতির পাশে মন্দিরে দেবীর মূর্তিটি স্থাপন করে নিজেদের মতো পুজোপাঠ শুরুও করলেন তাঁরা। পরবর্তীতে দেবী স্বপ্নাদেশ দেন, তিনি দশভুজা, দশআয়ুধা দেবী দুর্গা। এবং দুর্গা রূপেই পুজো পেতে চান। বৃহৎনন্দিকেশ্বর পুরাণ মতে হবে তাঁর আরাধনা।
কলিকালে রাজসূয় যজ্ঞের সমান ফল দেয় দুর্গাপুজো। কিন্তু সে যে বৃহৎ আয়োজন। এই সামান্য কয়েক জন শ্রমিকের দল তা কী ভাবে করবে? পথ দেখালেন দেবী নিজেই। অযাচিত ভাবেই এগিয়ে এলেন আশপাশের মানুষ। গড়ে উঠল মা দুর্গার মন্দির। আদ্যাশক্তি মা মহামায়া নিজের মধ্যে থেকেই উত্থিতা। তাই, সেই জায়গার নাম হল মহামায়াপাট।
এই পুজোই কোচবিহার অঞ্চলের প্রথম বারোয়ারি অর্থাৎ সর্বজনীন দুর্গাপুজো। সেই সময়ে, আজ থেকে ১৩৫ বছর আগে কোচবিহারে কেবলমাত্র বাড়ির বড় মায়ের পূজা এবং রাজ অনুকূল্যে স্থানীয় জমিদারদের গুটিকয়েক পারিবারিক দুর্গাপুজো হত। সেই একই সময়ে দাঁড়িয়ে মহামায়াপাটের পুজো হয়ে উঠল শ্রমিকদের পুজো, সাধারণের পুজো। এ বছর সেই উদযাপন ১৩৫তম বর্ষে পদার্পণ করল।
রথযাত্রার দিনে শুরু হয় কাঠামো পুজো। তার পরে ধীরে ধীরে খড় পড়ে, খড়ের উপরে মাটি— মৃন্ময়ী মা সেজে ওঠেন চিন্ময়ী রূপে। সেই শিলার পাশে স্থাপিত হয় মাতৃপ্রতিমা। আশেপাশের অঞ্চলে এমন কোনও মানুষ নেই, যাঁরা এই সময়ে পুজো দেখতে আসেন না।
একটা সময় ছিল, যখন সমগ্র কোচবিহারের মানুষ এই মন্দিরে আসতেন। এমনকী, বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়েও মানুষ ছুটে আসতেন। দেবীর পুজো দেখতেন, অষ্টমীর ভোগ খেতেন। ওই যে কথায় বলে, তিনি চাইলে সব হয়। না হলে যে সময়ে কেবলমাত্র রাজা জমিদাররা তাঁর পুজো করতেন, কয়েক জন শ্রমিক কী ভাবে সেই দেবীরই আরাধনা করলেন! আসলে সবই তাঁর ইচ্ছা, তিনি নিজের ইচ্ছায় সেবিতা।
তাই তো রামপ্রসাদ ঠাকুর বলেছেন,
“ তোমার কর্ম তুমি কর মা, লোকে বলে করি আমি। ”