উনিশ শতকের কলকাতা যেন বিচিত্র ভূমি। এক দিকে সমাজ সংস্কার আর অন্য দিকে বাবুয়ানি, দুই-ই দেখছে সে’কলকাতা। কত যে বিচিত্র বিচিত্র প্রথা, রেওয়াজ ছিল সেই সময়ে! তা কল্পনাতীত।
দেবী দুর্গাকে নিয়েও এক অদ্ভুত প্রথা প্রচলিত ছিল সেকালের কলকাতায়। বাড়িতে বাড়িতে দুর্গা প্রতিমা ফেলে যাওয়া হতো। এই প্রথার নাম ছিল ‘চাপিয়ে দেওয়া পুজো’ বা ‘চাপানো পুজো’।
বিত্তবান কিন্তু কৃপণ এমন মানুষদের বাড়িকে টার্গেট করা হতো। তারপর তাঁদের দরজায় দুর্গা প্রতিমা ফেলে আসা হতো। পয়সাওয়ালা পড়শির বাড়িতে এক-মেটে, দো-মেটে দুর্গা প্রতিমা (খড়ের কাঠামোর উপর একবার বা দুবার মাটির প্রলেপ পড়েছে এমন) ফেলে আসত পাড়ার ছেলেরা। ‘ব্যাটার টাকা খসুক’ এমন গোছের ভাবনা থেকে এটা করা হতো। প্রতিমা দোরগোড়ায় ফেলে গেলে পুজো করতেই হত। ঋণ করে, বাড়ির গিন্নির গয়না বাঁধা দিয়ে হলেও পুজোর আয়োজন করা হতো। দুর্গা ফেলে আসা দলের লোকেরা গৃহস্থের নাকানি-চোবানি খাওয়া দেখে মজা পেত। আশ্বিনের মাঝামাঝি শহর ও শহরতলির সম্পন্ন ঘরের লোকেরা দুরু দুরু বুকে দিন কাটাতেন, এই বুঝি কে দুর্গা ফেলে গেল!
প্রতিমা ফেলে গেলেই যে সবাই পুজো করতে মেতে উঠত এমনটা নয়। কেউ কেউ খরচের ভয়ে ফেলে যাওয়া প্রতিমা লুকিয়ে ফেলতেন। পুজো না করেই বিসর্জন দিয়ে দিতেন। প্রায় দু’শো বছর আগে বেলঘরিয়ার এক গৃহকর্তা বাড়ির দরজায় ফেলে যাওয়া দুর্গা প্রতিমা ভেঙে ফেলেছিলেন। কিপটে-শিরোমণি কিছু মানুষ আবার প্রতিমা থেকে সরস্বতীর মূর্তিটা সরিয়ে রেখে দিতেন। তা হলে মাঘ মাসে সরস্বতী মূর্তি কেনার টাকা বেঁচে যাবে।
দুয়ারে ফেলে যাওয়া দুর্গা প্রতিমা পুজো করা উচিত কি-না, তা নিয়ে দুই শিবিরে ভাগ হয়ে গিয়েছিল সমাজ। সংবাদপত্রগুলিতে ঠিক-বেঠিকের পাল্টা যুক্তিতে প্রতিবেদন লেখা চলত। ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ দুর্গা প্রতিমা ফেলার রেওয়াজের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। তাদের মত ছিল, বাড়তি খরচ হলে হোক। তাতে কেউ গরিব হয়ে যাবে না। বরং পরকাল সুখের হবে। প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করেছিল ‘সমাচার দর্পণ’। শেষ অবধি ব্যয় হচ্ছিল ট্যাঁকের কড়ি! পরকালের চেয়ে ইহকালের চিন্তা আগে আসে। এর পর এক সময়ে আস্তে আস্তে এই ‘চাপানো পুজো’র রেওয়াজ কলকাতা থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল।
১৮৩০-১৮৪০, এই এক দশকে কলকাতার দুর্গাপুজোয় ভাটার টান পড়ে। রাজা, জমিদার, বিত্তবানদের বাড়ির পুজোর ঠাটবাট কমে আসে। পুজোর সংখ্যাও কমতে শুরু হয়। কেবল আর্থিক কারণ ছিল না এমন প্রবণতার নেপথ্যে। ব্রিটিশদের পৃষ্ঠপোষকতার জন্যে কলকাতার পুজো ধারে-বাড়ে বেড়েছিল। পুজোর জাঁকজমক করা হতো সাহেবদের দেখিয়ে যাতে রায়বাহাদুর পাওয়া যায়, কোনও কাজ হাসিল করা যায়। সাহেবরাও ধনীদের বাড়ির পুজোয় আদর আপ্যায়নের লোভে দিনরাত পড়ে থাকতেন।
বলা ভাল, দুর্গাপুজোর আমোদে ভেসে গিয়েছিল সাহেবের দল। প্রাপ্তির আশায় এ দেশের জমিদার, রাজারা সাহেবদের তোষামোদের ত্রুটি রাখতেন না। নাচের আসর থেকে মদ-মাংসের এলাহি আয়োজনে ডুবে যেতেন সাহেবরা। এতে দু’পক্ষ বেজায় ক্ষেপেছিল। হিন্দুরা নিজেদের উৎসব সাহেবদের এ হেন অনুপ্রবেশ মানতে পারত না। অন্য দিকে, খ্রিস্টান মিশনারী হিন্দুদের সঙ্গে তাদের লোকদের এই গা মাখামাখি সইতে পারছিল না। সাহেবরা পৌত্তলিকতায় বিশ্বাসী হয়ে পড়তে পারেন মনে করে খ্রিস্টান মিশনারী ময়দানে নামে। জনৈক পাদ্রি রেভারেন্ড পেগ নিজেদের দেশে জোর আন্দোলন শুরু করলেন। হিন্দুদের পুজোয় গিয়ে নাচানাচি চলবে না। কাজ হল। ১৮৪০ সালে দশ নম্বরী আইন জারি হল। ইংরেজদের, হিন্দুদের উৎসবে গিয়ে মাতামাতি, তোপ দাগানো, পুজোর পৃষ্ঠপোষক হওয়া যাবে না। পুজোয় অংশগ্রহণও চলবে না। কলকাতার ধনীদের বাড়ির পুজোয় লোক দেখানো বৈভবের তাল কাটল! সাহেবরা সরতেই জমিদার, রাজারা জাঁকজমকপূর্ণ পুজো থেকে সরে এসেছিল। সে প্রভাব সামগ্রিক ভাবে পড়েছিল। কুমোরপাড়াগুলি ধাক্কা খেতে আরম্ভ করে। প্রতিমা বিক্রি হচ্ছে না। পুজো সামগ্রীর বিক্রি নেই। তখনই জাঁকিয়ে বসে দুর্গা ফেলার রেওয়াজ। কিছুটা বাণিজ্য-কৌশল হিসাবেও একদল দুর্গা ফেলার জিগির বাড়িয়ে তুলেছিল।
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।