Advertisement

Associate Partner

Style Partner

Associate Partner

Weddings Partner

Food Partner

Folk Culture In Kali Puja

লৌকিক কালী, পৌরাণিক কালী! কাহিনির শিকড়ে জড়িয়ে কত যে বিশ্বাসের আশ্চর্য গল্প!

নানা জনপদের নানান কালীর গল্প! কাহিনির পরতে পরতে লোক সংস্কৃতির আশ্চর্য বীজের সন্ধান।

তমোঘ্ন নস্কর
শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০২৩ ১৪:৫৫
Share: Save:

ছোট্ট এক ফালি ঘর। ভাঙাচোরা। টিনের ফাটল গলে আলো আর জল দুই-ই ঢোকে। তবুও, সেইখানে মমতায় নুয়ে পড়া এক শিল্পী পালিশ করে চলেছেন মুখোশ।শিল্পীর চোখের তলায় কালি পড়ে গেছে। মুখোশ তৈরির কাজে লেগে যাওয়ার পর সাতদিন রিকশাখানা বের করতে পারেননি তিনি। মুড়ি জল খেয়ে মুখোশ তৈরি করতেই ব্যস্ত রয়েছেন।

বড় বড় আয়ত চোখ, ঘনঘোর গাত্র বর্ণ, দন্তে সংযত লাল প্রলম্বিত জিহ্বা — মা কালীর মুখোশ। এই মুখোশ পরেই তোলা হবে সিধে, মাঙন। হবে, চণ্ডী নাচ, উড়ান কালী, মাসান কালী, ভদ্রকালীর নৃত্য। তাই এই মুখোশকে সব টুকু নিবেদন আর শ্রম দিয়ে বানান শিল্পী। মুখোশ মূর্তি গড়ার চেয়ে কম কিছু নয়।

কিন্তু জানেন কি, রাজবংশীদের মধ্যে চণ্ডী নাচ বা কালী নাচ অন্যতম অঙ্গ হলেও রাজবংশী সমাজে কালী ঠাকুরানি চিরায়ত মা কালী বা আদ্যা শক্তি-র থেকে একটু আলাদা।

রাজবংশী বিশ্বাসে, মা কালী ঠাকুরানি এক সর্বোত্তম স্ত্রী দেবী। যিনি সর্বমঙ্গলকারিনী এক লৌকিক ও পৌরাণিক দেবী। তিনি মাসান দেবতার মা/ স্ত্রী, গেরাম ঠাকুরের মতোই ক্ষেত্র রক্ষক।

তুফানগঞ্জের পালিকা গ্রামে মা কালী পূজিতা হন মনস্কামনা কালী রূপে। কথিত, কোনও এক সময়ে পালিকা গ্রামের এক বৃদ্ধা ভক্তি ভরে একটি বট গাছের নীচে মাসান ঠাকুর ও বুড়ো ঠাকুরের পুজো করতেন। গ্রামের মানুষদের কাছে সেই বৃদ্ধা এই দুই লৌকিক দেবতার মাহাত্ম্য বর্ণনা করতেন এবং সেই বর্ণনা করতে গিয়ে কালী ঠাকুরানির স্বপ্নাদেশের কথা বলে গিয়েছিলেন।

স্বপ্নাদেশের কথা শুনে গ্রামের মানুষ, বৃদ্ধা গত হওয়ার পর মায়ের মূর্তি গড়ে পুজো শুরু করে। খুব অদ্ভুত ভাবেই সন্নিকটস্থ একটি মরা বিল, পুজো শুরু হতেই জলে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। তার নাম হয় পালিকার বিল এবং তখন থেকে সেই বিলে স্নান করে মায়ের পুজোর রীতি প্রচলন হয়। আবার দেওয়ানহাটে মা কালীকে মাসান দেবতা রূপে পুজো করা হয়।

আশ্চর্য হল, সেই স্থলে মা তথা মাসান পূজিতা হন ঘটে। মঙ্গলবার ঘটের সম্মুখে মাসান দেবতার মতোই আটিয়াকলা, পাঁচখোল, চিড়ে, দই, পায়রা হাঁসের ডিম ইত্যাদি দিয়ে মায়ের নৈবেদ্য সারা হয়। পুজো দেন ভোঙরিয়া।

তেমনই তুফানগঞ্জে এক সিংহবাহিনী কালী মা আছেন! যে কালী মা একই সঙ্গে শাস্ত্রীয় এবং লৌকিক মতে পূজিতা। তার বাৎসরিক পুজো (রাস পূর্ণিমা) হয় শাস্ত্রীয় ব্রাহ্মণ কর্তৃক শাস্ত্রীয় মতে। কিন্তু নিত্য দিনের পুজো করেন স্থানীয় ভোঙরিয়া। মা এখানে লোকায়ত নামে 'রণকালী"।

তেমনই আছেন, ষড়ভুজা অথচ নীলবর্ণা সিংহবাহিনী ডাকিনী-যোগিনী সহ কালী ঠাকুরানি। তবে অদ্ভুত ব্যাপার হল মাধাই খালের কালী ঠাকুরানি। মা এখানে ভদ্রকালী রুপে পূজিতা। রংপুরের মাধাই খাল গ্রামের এক মানুষ কালী ঠাকুরানিকে এখানে এনে প্রতিষ্ঠা দেন। সেই থেকেই মা এখানে ভদ্রকালী রূপে পূজা পান। মন্দির ঘরে মা দক্ষিণমুখী অবস্থানে অধিষ্ঠিতা। মায়ের পুজোয় প্রচুর লোক সমাগম হয়।

অদ্ভুত ব্যাপার হল, মায়ের পাটের মাটি ও তুলসী পাতা অনেক দুরারোগ্য ব্যাধি সারে বলে বিশ্বাস করে ভক্তজন! সে স্বতন্ত্র কথা, কিন্তু ভাবুন দেখি, কালীপুজোয় তুলসী পাতা! এ এক প্রকার অসম্ভব!

আসলে, লৌকিক বিশ্বাসে স্থানীয় মানুষজন মা ভদ্রকালীকে লৌকিক দেবীকুল 'সাত বইনি'র অন্যতমা বলে মনে করে। এ ভাবেই, মা এখানে লৌকিক বিশ্বাসে মিশে যাচ্ছেন। আর তাই তো রাজরংশী মানুষ, মা কালীকে নিছক দেবী বলে না মেনে তাঁকে ঘরের 'মা' বলে মেনে, তার মুখোশ পরে নৃত্য করতে পারে।

আবার মুখোশেই ফিরে আসি। কালিমুখোশ মূলত ছাতিম, আম, পাকুড়, নিম গাছের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি হয়। গুঁড়ি কুঁদে মুখোশ তৈরী হয়। মালসার কালি, সিঁদুর, চুন দিয়ে হয় রঙ। পালিশ হয় তেঁতুলের বীজ গুঁড়ো করে।

শিল্পী মুখোশ গড়ার সময়ে সম্পূর্ণ নিরামিষ আহার করেন। তার পর শনি, মঙ্গলবার কিম্বা কালীপুজোর লগ্নে সেই মুখোশ পরে, হাতে টিনের খড়্গ নিয়ে নাচ দেখিয়ে ঘুরে বেড়ান শিল্পী।

ছড়িয়ে যায়, মা কালী ঠাকুরানির কথা আর তার সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য লৌকিক দেবদেবী বুড়া-বুড়ি, মাসান, জটাপাখির লৌকিক, পৌরাণিক, চলিত মাহাত্ম্য কথা...

এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।

অন্য বিষয়গুলি:

Kali Puja 2023 Kali Puja
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE