শঙ্খ-ঘণ্টা বাজিয়ে চলছে দেবী দুর্গার আরতি। বোল তুলছে ঢাক। তারই তালে ধুনুচি হাতে জমল নাচ। একে একে পা মেলালেন অনেকেই। পুজো মণ্ডপের চিরচেনা ছবি, তাই তো? অতীতে ধুনুচি কেবল ধূপ জ্বালানোর জন্যই ব্যবহৃত হত। পরবর্তীতে ভক্তরা ঢাকের তালে তাল মিলিয়ে ধুনুচি হাতে নাচ শুরু করেন। ধীরে ধীরে এটি দুর্গাপুজোর এক বিশেষ পর্বে পরিণত হয়। শারদীয়ার এই ধুনুচি নাচেরও কিন্তু আছে নিজস্ব মাহাত্ম্য।
ধর্মীয় মাহাত্ম্য-
দেবীর আরাধনা: ধুনুচিতে জ্বলন্ত কয়লা,ধূপকাঠি দিয়ে ধোঁয়া তৈরী করা হয়। বিশ্বাস করা হয়, এই ধোঁয়া দেবী দুর্গাকে সন্তুষ্ট করে এবং পরিবেশকে পবিত্র করে।
অশুভ শক্তি দূরীকরণ: পুজোয় ধূপ ও ধুনোর ধোঁয়া নেতিবাচক শক্তি দূর করে ইতিবাচক শক্তির বিস্তার ঘটায়।
ধুনুচির উৎপত্তি: ধুনুচি মূলত মাটির তৈরি এক ধরনের পাত্র, যাতে জ্বলন্ত নারকেলের ছোবড়া বা কয়লার উপর ধূপ জ্বালানো হয়। প্রাচীন কাল থেকেই পুজোয় পরিবেশ শুদ্ধি ও দেবতার আরাধনার জন্য এর ব্যবহার চলে আসছে।
সাংস্কৃতিক মাহাত্ম্য-
উৎসবের আনন্দ: ধুনুচি নাচ দুর্গাপুজোর আনন্দকে বহু গুণে বাড়িয়ে তোলে। ঢাক, কাঁসর, শঙ্খধ্বনি ও ধুনুচির ধোঁয়া মিলে এক মোহময় পরিবেশ তৈরি হয়।
সামাজিক বন্ধন: এই নাচে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলে অংশ নেয়। এ যেন এক সামাজিক মিলনমেলা।
ঐতিহ্য রক্ষা: বাংলার লোকসংস্কৃতির একটি বিশেষ প্রতীক হল ধুনুচি নাচ। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসছে এই ঐতিহ্য।
অষ্টমীর সকাল বা নবমীর রাত, সপ্তমীর সন্ধে হোক বা দশমীর ভাসান– ধুনুচি নাচ ছাড়া বাঙালির দুর্গাপুজো যেন অসম্পূর্ণ। ধুনুচিতে ধূপ, ধুনো দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে সেই জ্বলন্ত ধুনুচি কখনও হাতে, কখনো মুখে, কখনও বা কোমরে রেখে নাচের তালে মেতে ওঠা। ঢাকের তালের সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে নাচ এ যেন বাঙালির কাছে এক অনন্য মাত্রা বহন করে।
কিন্তু কেন হয় এই নাচ? দুর্গাপুজোর সঙ্গেই বা এর কী সম্পর্ক?
ধুনুচি নাচের প্রচলন: ধুনুচি নাচ প্রথম শুরু হয়েছিল জমিদার বাড়ির দুর্গাপুজোয়। পরে কলকাতা ও বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের বারোয়ারি পুজোয় এই প্রথা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আজ এটি দুর্গাপুজোর অপরিহার্য অঙ্গ তো বটেই, এমনকী প্রতিযোগিতার রূপও পেয়েছে।
পুরাণ অনুসারে, মহিষাসুর বধের আগে শক্তি সঞ্চয়ের জন্য ধুনুচি নাচে মেতেছিলেন মা দুর্গা। সেই থেকেই বিশ্বাস, এই নাচের মাধ্যমে সম্পূর্ণ ভাবে নিজেকে মা দুর্গার কাছে সমপর্ণ করা যায়। আর এতেই দূর হয় সমস্ত অশুভ শক্তি। জ্বলন্ত ধুনুচি হাতে এই নাচের রীতি তাই চলে আসছে বছরের পর বছর ধরে।
এই প্রতিবেদনটি 'আনন্দ উৎসব' ফিচারের একটি অংশ।