গুপ্তিপাড়া স্টেশনের আগেই কালনা-কাটোয়ামুখী স্টেট হাইওয়ে ছেড়ে লেভেল-ক্রসিং পেরোলাম। দু-একজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে রথতলার মাঠের পাশে গুপ্তিপাড়ার গুপো সন্দেশের মুখচোরা দোকানগুলোর মায়া কাটিয়ে বৃন্দাবনচন্দ্র মঠের পাকারাস্তায় বাঁক নিতে হল। বৃন্দাবনচন্দ্রের মঠ গুপ্তিপাড়ার বিখ্যাত মন্দির, সবাই চেনে। বলা উচিত মন্দির সমূহ। তার টেরাকোটা বিষ্ণুপুরের থেকে নামে খাটো, দর্শনে আর চরিত্রে খাটো কিছু নয়। এছাড়া কিছু বিচিত্র দেওয়ালচিত্রও আছে, যারা কালের আর অপরিকল্পিত পুনরুদ্ধারের প্রকোপে ক্রমশ ফিকে, নয়তো বিকৃত হচ্ছে। গুপ্তিপাড়ার নামকরা জগন্নাথের রথও তার যাত্রা শুরু করে এই মন্দির থেকেই।
আমাদের গুপ্তিপাড়া আসার মুখ্য উদ্দেশ্য কিন্তু অন্তত এই যাত্রায় বৃন্দাবনচন্দ্র মঠ দেখা নয়। মঠের একটু আগেই রাস্তার উপরে বাঁদিকে অধুনানির্মিত ‘দেশকালী’ মন্দিরের মুখে যে আকাশজোড়া গাছতলা, তার শাখায় শাখায় গুচ্ছ-গুচ্ছ ফলখেকো বাদুড় বাদুড়ঝোলা হয়ে আগন্তুকদের মাথা গুনছে। গাছের গোড়ায় বালগোপালের ৫ ফুট উঁচু গোলিয়াথ মূর্তি কতকটা ভূমিস্পর্শমুদ্রায় ঠায় বসে; হাতের আঙুলগুলো ঝড়ে-জলে-বৃষ্টিতে গলে পড়ছে, তবু ভ্রুক্ষেপ নেই। এরই গা ঘেঁষে মেঠো গ্রাম্য রাস্তা ঢুকে গেছে উত্তরপানে। একটা গাড়ি কোনওক্রমে যেতে পারে, তাও কারও পাশ কাটাতে গেলে দু-ধারের ঝোপঝাড়গুলোকে তাদের ফুলপাতা খুইয়ে মূল্য চোকাতে হয়। এই রাস্তায় দুশো গজ মতো গিয়ে বাঁহাতে একটা খোলা মাঠ আর তারই একপাশে একটা ছোটখাটো পাকা মণ্ডপ। দেবী বিন্ধ্যবাসিনীর পুজো হয়, বহুবছর ধরে, নিয়মিত। পাকা মণ্ডপ বেশি দিনের নয়, তবু তার স্থাপনাও নয় নয় করে ৭৯ বছর হল। প্রস্তর ফলকে লেখা আছে,‘শ্রীশ্রীবিন্ধ্যবাসিনী মাতার পূজামণ্ডপ/ শ্রীসতীশ চন্দ্র সেন মহাশয়ের ব্যয়ে নির্ম্মিত / সন ১৩৪৬ সাল’ । আর তারই একটু তলায় অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের চতুষ্কোণ দ্বিতীয় ফলক– যেটা দেখবার জন্যে এই ৯০ কিলোমিটার পথ ঠেঙিয়ে কলকাতা থেকে এখানে আসা। তাতে লেখা - ‘বারোয়ারী সৃষ্টিস্থান / গুপ্তিপাড়া বারোয়ারী ঁবিন্ধ্যবাসিনী পূজা / প্রতিষ্ঠিত: সন ১১৬৮ সাল (আনুমানিক)’।
বারোয়ারি শব্দের একাধিক উৎস বাংলার মনীষীরা নির্দেশ করেছেন। যেমন বারোপকারিক থেকে (রাজশেখর বসু : চলন্তিকা), বারো + ওয়ারিস থেকে (রাধারমন রায়), বার+ওয়ারি থেকে (আচার্য যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি) ইত্যাদি। কিন্তু যে উৎস সর্বজনের কাছে বেশি প্রচলিত বা প্রচারিত, তা হল ‘বারো’ যুক্ত ‘ইয়ার’ থেকে ‘বারোয়ারি’। বারোজন ইয়ার বা বন্ধু মিলেই নাকি এই ধরনের পুজোর প্রথম আয়োজন করেন। এর পিছনে গল্প একটা নিশ্চয় আছে।